তাহলে তুই এঘরে একা থাকিস কেন?
এমনি।
কিছু ফিল করিস না? কিছুই না।
ফিল করি। বাবাকেই ফিল করি। তবে সেটা ভূতকে নয়, লোকটাকেই।
তার মানে?
বাবার ক্যারেকটার, বাবার ইমপ্রেশন এঘরে ছড়িয়ে আছে। অ্যাটমসফিয়ার কিছু ক্যারি করে। আমি সেটাকেই ফিল করি। বাবার বিছানায় ঘুমোই, বাবার টেবিলে বসে লেখাপড়া করি, বাবার জিনিসপত্র ছুঁই, আর এভাবে বাবাকে ফিল করি। তার বেশি কিছু নয়।
–তুই ব্রেভ। দারুণ ব্রেভ।
সঞ্চারি ঈর্ষার চোখে তিথির দিকে চেয়েছিল। তিথি যে দারুণ সাহসী তাতে সন্দেহ নেই। এত সাহস তার নেই, এবাড়ির কারো নেই। হঠাৎ সঞ্চারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমাদের যে কী হবে?
বুক্কা তেমনি গা ছেড়ে এসে খুব নির্বিকার গলায় বলে, কী আর হবে। উই হ্যাভ বিকাম রিয়েল পুওর। দিদির বিয়ে হওয়ার চান্স নেই, আমার হায়ার এডুকেশন হবে না, তিথির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
তিথি একটু অবাক হয়ে বলে কীসব বলছিস?
বুক্কা তেমনি উদাস গলায় বলে, হু-হু বাবা, সব জানি। মার সঙ্গে মামার রোজ এসব নিয়ে ডিসকাশন হচ্ছে। দেয়ার ইজ নাথিং লেফট। বাবার ব্যাংকে তেমন টাকা ছিল না, ইনসিওরেন্স পলিসি যা আছে তা সামান্য টাকার। কোম্পানির কাগজটাগজও কিছু নেই। অলমোস্ট ব্যাংকরাপ্ট। থাকার মধ্যে আছে শুধু এই বাড়িটা।
সঞ্চারি উত্তেজিত হয়ে বলে, বাবার কনসালটেন্সি তো ছিল।
মামা সব খবর নিয়েছে। কনসালটেন্সি ভালো চলত না। অফিসের ভাড়া পর্যন্ত ক্লিয়ার নেই। উই হ্যাভ বিকাম ভেরি পুওর।
তিথি জানে বুক্কা মিথ্যে বলছে না। তার বাবার টাকার নেশা ছিল না, জমাতেও ভালোবাসত না। অনেকবার বলেছে, জমাব, কার জন্য? ছেলেপুলের জন্য? ওরা নিজেরা যদি উপার্জন করতে না-শেখে তাহলে ভুগবে। বাপের উপার্জনের ওপর নির্ভর করবে কেন?
বিপ্লব দত্ত টাকা খরচ করত জলের মতো। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে। বিপ্লব দত্তের ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে প্রাচুর্যের মধ্যে। একটার জায়গায় চারটে পোশাক করে দিত বাবা। তাদের প্রত্যেকের পাঁচ-সাত জোড়া করে জুতো। ঘরে মেলা আসবাব।
সঞ্চারি আতঙ্কের চোখে চেয়েছিল ভাইয়ের দিকে, তুই সব শুনেছিস।
সব। আমার সামনেই তো কথা হয়।
সঞ্চারি হাঁটুতে মুখ গুঁজল। বুক্কা একটা অনির্দিষ্ট তাল বাজাল টেবিলে। তিথি সামান্য আনমনা হয়ে গেল।
.
০৩.
থলি থেকে বেড়াল বেরুলো আরও দু-মাস বাদে। সোমনাথ এসে এক ঝোড়ো বাদলা বাতাসের দিনে ওপরের ডাইনিং হল-এ বসল। পরনে একটু ভারি জামাকাপড়। বাইরে ঋতু বদলাচ্ছে। এই বাদলাবাতাস শীতের আগমনি গাইছে। এবার হয়তো শীতটাও পড়বে জেঁকে।
বেলা এগারোটা। এ সময়টায় রান্না-খাওয়া স্নান ইত্যাদির একটা ব্যস্ত সময়। শুধু মিলি দত্তের তেমন কোনো কাজ নেই। বিষণ্ণ মুখে মিলি একটা সাদা সোয়েটার বুনে তুলছে। খুবই সাদামাটা ডিজাইন। বরাবরই মিলি দত্তের এটা একটা প্রিয় কাজ। আসলে শখ। এই শখের জন্য এবাড়িতে সকলেরই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি একাধিক সোয়েটার আছে।
কী রে সোমনাথ, কোথা থেকে এলি?
ওফ, অনেক ঘুরে-টুরে। শোনো ছোড়দি, ব্যাপারটা হোপলেস।
মিলি দত্ত যেন আরও একটু কুঁকড়ে গিয়ে বলে, কীরকম?
এবাড়িটার দরুন এখনও অনেক আউটস্ট্যাণ্ডিং লোন রয়ে গেছে। অফিসেও বিস্তর লায়াবিলিটিজ। তিনটে প্রোজেক্ট মার খেয়ে গেছে। পাওনাদার ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। অফিসের ভাড়া চার মাস বাকি। তুমি কি জান যে জামাইবাবু অফিসের জন্য একটা কম্পিউটার কিনেছিল?
কিছু তো বলত না আমাকে।
কিনেছিল। লোকটা কীভাবে টাকা উড়িয়েছিল ভাব একবার। কোনো মানে হয় মাত্র কয়েক লাখ টাকার টার্নওভারের জন্য একটা কম্পিউটার কেনার?
মিলি দত্ত উল বোনা থামিয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইল। সেই চেয়ে থাকার কোনো অর্থ নেই।
সোমনাথ দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, কোনো মানে হয় না, একদম মানে হয় না।
এখন আমরা কী করব?
দেনা মেটাতে হলে মিনিমাম তিন-চার লাখ টাকা এখনই দরকার। এ ছাড়া তো পথ নেই।
তার মানে বাড়িটা বিক্রি করতেই হবে?
তোমার যা গয়না আছে তা দিয়ে তো হবে না। বাড়ি বিক্রি ছাড়া আর তো পথ দেখছি না।
সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু তিনটে বাচ্চা নিয়ে আমি কোথায় গিয়ে উঠব বল তো। সংসারই বা চলবে কী করে?
ওঠবার ভাবনা কী? আপাতত আমাদের কাছে। তারপর দেখা যাবে ধীরে-সুস্থে।
মিলি মাথা নাড়ল, ছেলে-মেয়েদের তুই চিনিস না। ওরা কোথাও যাবে না। কারো ডিপেণ্ডেন্ট হওয়া ওদের ধাতে নেই। বাপের স্বভাব পেয়েছে। ও আইডিয়া ছাড়তে হবে।
তাহলে কী করবে? তুমি সিচুয়েশনটা বুঝতে পারছ তো?
মিলি নিষ্কল উল আর কাঁটায় ভুল ঘর তুলতে লাগল আনমনে। ভ্রূ কোঁচকানো। খুব স্তিমিত গলায় বলল, খুব পারছি। আমি এখন অগাধ জলে, এই তো!
বলতে গেলে তা-ই।
এবাড়ি বিক্রি করলে কত টাকা পাওয়া যাবে?
ইট ডিপেণ্ডস। দশ থেকে পনেরো লাখ হয়তো।
তার থেকে দেনা শোধ করলে কত থাকবে আমার হাতে?
খুব খারাপ নয়। যা থাকবে হিসেব করে চললে তোমার চলে যাবে। ঠিকমতো ইনভেস্ট করতে পারলে ভালোই চলবে। তবে এতটা ভালো নয়।
এছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই?
তোমার আর অ্যাসেট কোথায় ছোড়দি? কী দিয়ে দেনা শোধ করবে? শুধু বাড়িটার কথাই বলছি, কেননা বাড়িটা তোমার নামে। জামাইবাবুর নামে হলে সাকসেশন সার্টিফিকেট বের করতে জান বেরিয়ে যেত। আরও গাড্ডায় পড়ে যেতে। তোমার ভাগ্য ভালো, জামাইবাবু বাড়িটা তোমার নামে করেছিল। দি ওনলি ক্লেভার থিং হি এভার ডিড।