সুইসাইড নোটটা বুক্কা টেবিলের ওপর আলগা রেখেছিল। চাপা দেয়নি। বাতাসে সেটা পালটি খেয়ে উড়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বুক্কাই সেটা ধরে ফেলল।
সঞ্চারি দু-হাঁটু তুলে দু-হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে বসা, জোড়া হাঁটুর ওপর তার থুতনি। বুক্কা বসেছে চেয়ারে হেলান দিয়ে, এলিয়ে, দু-পা সামনে ছড়িয়ে। তিথি পা মেঝেয় রেখে বিছানায় বসেছে সোজা হয়ে, যেন-বা সে এবাড়ির লোক নয়, অভ্যাগত মাত্র, এখনই চলে যাবে।
সঞ্চারি একদৃষ্টিতে তিথির দিকে চেয়েছিল। বলল, বাবা যে লিখেছে–লাইফ ওয়াজ অল ফান, ইট ইজ ফানিয়ার টু টেক ইট অ্যাওয়ে–একথা কেন লিখল বল তো! বেঁচে থাকাটা না-হয় ফান বোঝা গেল, কিন্তু মরাটা কি আরও মজার?
বুক্কা মাথা নেড়ে বলল, বাবা মোটেই মজা করার লোক ছিল না। ওরকম সিরিয়াস লোকের কাছে জীবনটা কখনোই ফান হতে পারে না। আমার কাছে বাবার এই সুইসাইড নোটটা খুব অদ্ভুত লাগছে। যেন এটা বাবার লেখাই নয়।
সঞ্চারি বিরক্ত হয়ে বললে, বাবার নয় তো কার লেখা? বাবার হাতের লেখা চিনিস না!
–চিনি। বাবারই লেখা। তবু মনে হচ্ছে এটা লিখবার সময় বাবা ঠিক বাবার মতো ছিল না। কিছু একটা ভর করেছিল বাবার ওপর।
সঞ্চারি তার ভ্রূ তুলে বলে, ভর! ভর মানে?
–হি ওয়াজ পজেজড বাই সামথিং।
–সেই সামথিংটা কী?
–আমি কী করে বলব? লেট আস ইনভেস্টিগেট। আমার মনে হয় তিথি বলতে পারে। শি ওয়াজ ক্লোজ টু হিম।
তিথির মুখ প্রতিদিনই সারাক্ষণ গম্ভীর থাকে। আজ আরও গম্ভীর। সে দাদা বা দিদির বেশির ভাগ কথারই জবাব দেয় না। বুক্কার একথারও জবাব দিল না। তবে তার মনে হল, কথাটা বুক্কা খুব মিথ্যে বলছে না। বাবার কাছে জীবনটা খুব মজার ছিল বলে তার তো মনে হয়নি কখনো। ই.এম.এস.-এর ইঞ্জিনিয়ার ছিল বিপ্লব দত্ত। একটু মিলিটারি ধাঁচ ছিল স্বভাবে। রিটায়ারমেন্টের অনেক আগেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিপ্লব দত্ত কনসালটেনসি খুলেছিল। তারপর থেকেই যেন আরও গুটিয়ে যাচ্ছিল নিজের মধ্যে। আর এই যে সংসারের সকলকে পাশ কাটিয়ে নীচের ঘরে একা ভূতগ্রস্তের মতো থাকা এটাও তার মজাদার জীবনের লক্ষণ তো নয়।
বুক্কা তিথির দিকে চেয়ে বলল, তুই এঘরে কী করে একা থাকিস বল তো তিথি, ইউ মাস্ট বি এ ভেরি ব্রেভ গার্ল। আমি তো সবসময়ে ফিল করি দেয়ার ইজ সাম স্পিরিট অর সামথিং ইন দিস হাউস।
সঞ্চারি ভাইয়ের দিকে ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে বিরক্ত গলায় বলে, আবার ওসব কথা! বলেছি না ওটা সাইকোলজিক্যাল! কেউ মারা গেলে কিছুদিন ওরকম ফিলিং হয়।
বুক্কা মাথা নেড়ে বলে, মোটেই নয়। আই হিয়ার থিংস, আই সি থিংস।
তিথি সামান্য একটু হাসল। ইস্পাতের মতো হাসি। এ-বাড়ির সকলের কাছেই বাবা এখন ভূত! সে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, তুই কি বাবার ভূতকে দেখেছিস?
বুক্কা একটু অস্বস্তিতে পড়ে বলে, ঠিক তা নয়। কিন্তু সামথিং। ঠিক বোঝানো যায় না। আজকাল মাঝে মাঝে আমার অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায়। তখন আই ফিল সামথিং। মনে হয় মশারির বাইরে কে যেন এসে দাঁড়িয়ে আমাকে একদৃষ্টে দেখছে। আমি বাথরুমে শব্দ শুনতে পাই, কে যেন বেসিনে মুখ ধুচ্ছে বা ফ্লাশ টানল। অথচ কেউ ওঠেনি অত রাতে।
তিথি দৃঢ়স্বরে বলে, বাবা তো দোতলার বাথরুম ব্যবহারই করত না। বাবা থাকত এঘরে, নীচে।
বুক্কা অসহায় গলায় বলে, সেটা কোনো যুক্তি নয়। আই ফিল এ ভেরি মিস্টিরিয়াস প্রেজেন্স অফ সামবডি।
সঞ্চারি ধমকের স্বরে বলে, তোর সামবডি আর সামথিং নিয়ে তুই থাক গে। বুদ্ধ কোথাকার!
তুইও তো ভয় পাস দিদি, বেশি বাহাদুরি দেখাতে হবে না। ব্রেভ হল তিথি। রিয়াল ব্রেভ।
আমি মোটেই ভয় পাই না। বাসন্তী ভয় পায় বলেই আমার কাছে এসে শোয়।
তুই তো মাকেই বলেছিস যে তুইও এরকম কিছু ফিল করিস আজকাল।
সঞ্চারি চোখ পাকিয়ে কী বলতে যাচ্ছিল, তিথি উঠে পড়ে বলল, তোরা যদি ঝগড়া করিস তাহলে বরং আমি যাই।
বুক্কা সঙ্গেসঙ্গে গুটিয়ে গিয়ে বলে, ঝগড়া করছি না। এনিওয়ে বাবা, আমি স্বীকার করছি যে আমি ভীতু ছেলে। বাবার এই নোটটা পড়ে আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাবা শেষ সময়টায় খুব মজা পেয়েছিল। মরবার আগে খুব হো: হো: করে হেসে উঠেছিল নিশ্চয়ই।
সঞ্চারি চাপা গলায় বলল, ইডিয়ট। গাধা।
বুক্কা তিথির দিকে চেয়ে করুণ গলায় বলে তাই মনে হচ্ছে নারে তিথি? তুই-ই বল।
তিথি মৃদু স্বরে বলল, সে-কথা বাবা ছাড়া কেউ বলতে পারে না।
বুক্কা তিথির দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, তুই একটা কথা সত্যি করে বলবি?
–কী কথা?
–আমার মনে হয় বাবার ইনসিডেন্টটা সম্পর্কে একমাত্র তুই সব জানিস।
–আমি! আমি কী করে জানব?
–বাবা তোকে খুব ভালোবাসত, তুইও বাবাকে।
–তাতে কী?
বাবা মরবার পর তোকে এসে সব বলে যায়।
তার মানে?
বুক্কা পরমবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, বাবার ঘোস্ট এবাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় কাউকে কিছু বলতে চায়। আর তুই এঘরে–ইন দি রুম দি ইনসিডেন্ট টুক প্লেস–একা থাকিস। আমার মনে হয় বাবা তোকে এসে সব বলে যায়।
সঞ্চারি চাবুকের মতো গলায় বলে, শাট আপ!
বুক্কা নির্বিকার মুখে বলে, তুই কী বলিস তিথি?
তিথি খুব উদাস মুখ করে বলে, বাবার আত্মা আমার কাছে কখনো আসেনি। ওসব আমি বিশ্বাস করি না।