যাকে আদ্যন্ত অসহায় বলে মিলি দত্ত ঠিক তাই। মিলি দত্ত একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কোনও কিছু নির্ধারণ করতে পারে না, কোনো মানুষ কেমন তা বিচার করতে পারে না, কোন দিন কী রান্না হবে তা ঠিক করতে পারে না, মিলি দত্ত ভিসি আর বা স্টিরিও চালাতে পারে না, মিলি দত্তের এইসব খামতিকে কোনোদিন নেগেটিভ সাইড বলে ভাবে না তিথি। কে জানে হয়তো এগুলোরও কিছু প্লাস পয়েন্ট থাকতে পারে।
মিলি মেয়ের দিকে চেয়ে ছিল প্রায় অপলক চোখে। স্বামী আত্মহত্যা করলে সন্তানেরা কি ভাবে বাবার মৃত্যুর পিছনে মায়ের গঞ্জনা আছে? মিলি দত্ত আজকাল ছেলে-মেয়েদের দিকে যেরকম ভয়ে ভরা চোখ নিয়ে তাকায় তাকে ইংরেজিতে বলে শীপিশ।
তিথির পরনে এখনও ছাইরঙা ট্র্যাক স্যুট, পায়ে কেডস। আজ এগুলো ছাড়ার কথা খেয়ালই হয়নি তার।
–চিঠিটার কথা কি আমাদের কাউকে বলা দরকার?
তিথি ভ্রূ কুঁচকে বলল, না। এ চিঠিটার আর কোনো মূল্য নেই। এটা আমার কাছেই থাকবে।
–কী দরকার ওসব রেখে? ওটা কি ভালো চিঠি?
তিথি মাথা নেড়ে বলল, ভালো-খারাপ কিছু নয়। থাক না।
–আমার কেমন যেন ভয় করছিল চিঠিটা পড়তে। কীসব লিখেছে। কেমন মানুষ ছিল তোর বাবা?
বাইশ বছর ঘর করার পর স্বামী সম্পর্কে এরকম অকপট প্রশ্ন একমাত্র মিলিই করতে পারে।
তিথি বলল, মাই ড্যাড ওয়াজ ফ্যান্টাস্টিক। সিম্পলি ফ্যান্টাস্টিক।
মিলি চা খেল। খুব ধীরে ধীরে।
-তুই আবার আজ থেকে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলি?
–হ্যাঁ মা।
–ওসব করলে তোর চেহারাটা বড্ড রুক্ষ হয়ে যায়।
–তা যায়। তাতে কী?
মিলি মাঝে মাঝে ভ্রূ কোঁচকায়। ওটা ওর মুদ্রাদোষ। এখনও কোঁচকাল। বাইরের ঘরে দেয়ালজোড়া মস্ত এক শো-কেস। মিলির চোখ এখন সেই দিকে।
শো-কেসে দেখার কিছু নেই। কোথাও দেখার তেমন কিছু নেই। মানুষ তাই স্মৃতির মধ্যে ডুবে অতীতকে দেখতে থাকে। অতীত তার চারদিকে মিলেমিশে একাকার এক সময়হীন উলটোপালটা ছবি বিছিয়ে দেয়।
মিলিকে এই অবস্থায় রেখে তিথি চলে এল নীচে। বাথরুমে গিজার চালু করল। হট অ্যাণ্ড কোল্ড শাওয়ার তার খুব প্রিয়। তারপর পোশাক না-ছেড়েই সে বাবার ঘরখানা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল আনমনে। দেখার কিছুই নেই এবং বহুবার দেখা। তবু গত একমাস ধরে এঘরের নানা জিনিসে সে বাবাকে অনুভব করছে। এঘরে বাবার কোনো ছবি নেই। বিপ্লব দত্ত ফটো ভোলাতে ভালোবাসত না। আরও অপছন্দ করত ফোটোর ডিসপ্লে। বাবাকে মনে করার জন্যে অবশ্য তিথির কোনও ফোটোগ্রাফ দরকার নেই।
দুটো বুক কেস, একটা ওয়ার্ডরোব, একটা ডিভান, ছোটো হাফ সেক্রেটারিয়েট টেবিল এবং স্টিলের একখানা চেয়ার। মোটামুটি এই হল আসবাব। বিপ্লব দত্তের ডায়েরি লেখার কোনো অভ্যাস ছিল না। কিন্তু কয়েকটা ডায়েরি খুঁজে পেয়েছে তিথি। সেগুলির বেশির ভাগের মধ্যেই কিছু লেখা নেই। দু-একটা পাতায় কিছু মন্তব্য আছে। যেমন দু-বছর আগে একদিন তার বাবা লিখেছিল, ওঃ ইটস গোয়িং টু বি অ্যান অফুল ডে। গড। আরেকটাতে ছিল, আননোন। আরেকটাতে ছিল, অ্যাডিউ স্মোকিং।
সিগারেট ছাড়তে বিপ্লব দত্তের খুবই কষ্ট হয়েছিল, এটা বেশ মনে আছে তিথির। লবঙ্গ চিবিয়ে ছিবড়ে করে ফেলত আর ঝালের চোটে উঃ আঃ করত।
লোকটাকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মরবেই যদি তাহলে সিগারেট ছাড়লে কেন? তোমার কেন কোনও লাইফ প্ল্যানিং ছিল না?
স্নানের আগে কিছুক্ষণ যোগব্যায়াম। তিথি যন্ত্রের মতো তার আসনগুলো করে গেল। স্নান করল। পোশাক পরল। জিনস আর কামিজ।
সিঁড়িতে প্রবল পায়ের শব্দ তুলে তিথির ঘরে এসে হামলে পড়ল দু-জন। বুক্কা আর সঞ্চারি।
বুক্কা বলল, বাবার সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে?
তিথি গম্ভীর মুখে বলল, হ্যাঁ।
–দেখাবি?
তিথি বের করে দিল।
বুক্কা তাদের তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত। একটু মোটাসোটা। খুব খেতে ভালোবাসে। বুক্কার সঙ্গে বাবার একটু আড়াআড়ি ছিল বরাবর। বুক্কা বাবার ছেলের চেয়েও বেশি মায়ের ছেলে। বুক্কার ভুবনজোড়া মা। এখনও সে মায়ের কোল ঘেঁষে শোয়। এখনও বায়না করে। বাবাকে ভয় পেত, একটু এড়িয়ে চলত।
সঞ্চারি আর তিথি দুই বোন। সঞ্চারি বড়ো, তিথি ছোটো। তিথি সকলের ছোটো। কিন্তু সঞ্চারির সঙ্গে তিথির কোনো মিল নেই। সঞ্চারি গৌর বর্ণের, তিথির রং মাজা। সঞ্চারি ঢলঢলে, তিথির চেহারা একটু রুক্ষ আর কেঠো। মনের মিলও দু-জনের বিশেষ নেই।
এবাড়ির কার সঙ্গেই বা তিথির মনের মিল? আজকাল তিথি কারো সঙ্গে তেমন কথা বলে না।
সঞ্চারি বুক্কার হাত থেকে নোটটা নিয়ে কুঁচকে দেখল। বলল, এর মানে কী?
তিথি বলল, তুই বুঝবি না।
-তুই বুঝেছিস?
তিথি সঞ্চারির দিকে একঝলক তাকাল। সে চোখে তাচ্ছিল্য। কথাটার জবাব দেওয়ার মানেই হয় না।
যদিও সঞ্চারি তিথির চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো তবু সে তিথিকে সমঝে চলে। একটু ভয়ও খায়। ভয় খায় বুক্কাও, দু-বছরের বড়ো, দখলদার এবং মাতব্বরি করার অধিকারসম্পন্ন দাদা হওয়া সত্ত্বেও। তিথি কারো সঙ্গে ঝগড়া কাজিয়া করে না, তর্কে যায় না, বেশি কথাও কয় না। তবু তিথিকে সবাই একটু এড়িয়ে চলতে চায়। চোখে চোখ রাখে না। তার মতামতকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুরুত্ব দেয়। তিথি জানে।
বুক্কা চেয়ারে বসল, সঞ্চারি আর তিথি বিছানায়। বিপ্লব দত্তের মৃত্যুজনিত শোক এবাড়ি থেকে একরকম বিদায় নিয়েছে। যা আছে তা একটু শূন্যতামাত্র। সময়ের প্রলেপ সেই ফাঁকটুকু ভরিয়ে দেয়।