এমনকী বাসন্তী কাজ ছেড়ে দেওয়ার হুমকি অবধি দিয়েছে মাঝে মাঝে।
এবাড়িতে কেউ ভূতে বিশ্বাস করত না বা এখনও করে না। কিন্তু বিপ্লব দত্ত মারা যাওয়ার পর সকলেই একে একে কিছু সংকোচের সঙ্গে এবং নানা অমোঘ অজুহাতে ঘর বদল করে ফেলল। বুক্কা চলে এল মায়ের ঘরে। হলঘরে বাসন্তী মেঝেতে আর সঞ্চারি সোফা কাম বেডে শুতে লাগল।
তিথিও ঘর বদলাল। তবে সেটা প্রতিবাদ হিসেবে। মৃত বাবাকে তার কোনো ভয় নেই। নিজের ঘর ছেড়ে সে চলে এল একতলায় তার বাবার ঘরে–যে ঘরে তার বাবা আত্মহত্যা করেছে!
মিলি রাগ করে বলল, এসব কী হচ্ছে তিথি? মোটেই ভালো নয়। আমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না, কিন্তু মানুষের মনের ইমপ্রেশন তার চারদিকের অ্যাটমসফিয়ারে থেকে যায়। তোমার নিজের দক্ষিণ খোলা ঘর থাকতে ও ঘরে যাচ্ছ কেন?
তিথি উত্তর দেয়নি। কিন্তু মায়ের কথাও শোনেনি।
গত দু-মাস তিথি এঘরে আছে। একা। বাবার খাটে শোয়। বাবার টেবিলে লেখাপড়া করে। গভীর রাত অবধি জেগে থেকে ভাবে জন্মের কথা। মৃত্যুর কথা।
সে পায়ের শব্দ বা কাশির আওয়াজ শোনেনি। সিগারেটের গন্ধ পায়নি। দেখেওনি কোনো ছায়ামূর্তিকে। গভীর রাতে সবাই ঘুমোলে ঘুমহীন তিথি সারা বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছে ভূতের মতো। ছাদে, বারান্দায়, ঘরে ঘরে।
কিন্তু আজ সকালে বিপ্লব দত্তর সুইসাইড নোটটার দিকে চেয়ে থেকে তার মনে হল, বাবা যেন খুব কাছে। আর এই যে ভূতুড়ে বাতাস আর কোকিলের ডাক–এর ভিতর দিয়ে তার বাবাই যেন কিছু বলতে চাইছে তাকে।
.
০২.
বিপ্লব দত্ত মারা যাওয়ার পর কোনো সুইসাইড নোট আছে কিনা তা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। পাওয়া যায়নি। সোমনাথমামা শেষ অবধি বিরক্ত হয়ে বলে ফেলেছিল, হি ওয়াজ এ ভেরি ইরেসপনসিবল গাই। নিজের ফ্যামিলি হ্যারাসড হোক এটাই কি চেয়েছিলেন উনি? কোনো ভদ্রলোক তা চায়?
বিরক্ত মিলি দত্তও হয়েছিল। তবে সেটা প্রকাশ করেনি।
কেন নোটটা তখন পাওয়া যায়নি তা ধীরে ধীরে আজ সকালে বুঝতে পারল তিথি। বাবা সবসময় একগাদা বই নিয়ে শুতে যেত রাতে। অনেক রাত অবধি পড়ত। ঘুম পেলে বেডসুইচ টিপে ঘুমিয়ে পড়ত। সকাল বেলায় বিছানা থেকে বইগুলো সরিয়ে আবার বুক কেসে ভরত ঠিকে কাজের মেয়ে একা–অর্থাৎ একাদশী। সেদিনও তাই করেছিল। একা তো আর জানত না বিপ্লব দত্ত কবিতার বইতে তার সুইসাইড নোট গুঁজে রেখে গেছে। সে যখন বিপ্লব দত্তের বিছানা থেকে বই সরায় তখন লোকটি যে মারা গেছে একথাও তার জানা ছিল না। বিপ্লব দত্ত রোজকার মতোই কাত হয়ে পাশবালিশ জড়িয়ে শুয়ে ছিল। প্রায় তিন দিন ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টির পর সেদিনই পরিষ্কার আকাশে ভোরের রোদ দেখা দিয়েছিল। চমৎকার ছিল আবহাওয়া। সেদিন খবরের কাগজে খুন-জখম দুর্ঘটনার খবর ছিল খুবই কম। সেদিন একটি বিরল দোয়েল শিস শুনিয়ে গিয়েছিল। শিউলি গাছে শরতের প্রথম ফুল সেদিনই দেখেছিল প্রথম সঞ্চারি, মা, দেখে যাও শিউলি ফুল!
বাবাহীন পৃথিবীতে দু-মাস কেটে গেল। কাটবে বলে বিশ্বাস ছিল না তিথির। নোটটা হাতে নিয়ে তিথি খুব ধীর পায়ে বারান্দায় আরও আলোর মধ্যে এসে দাঁড়াল। বাঁকা জোরালো হাতের লেখা সুইসাইড নোটটার দিকে তাকিয়ে থেকেই সে শুনতে পেল, বাগানের ফুলে ফুলে মৌমাছির শব্দ। গ্যারেজের ওপাশে রাজমিস্ত্রিরা একটা ঘর করেছিল টিনের। ঘরটা ভাঙা হয়নি আজও। অনেক অব্যবহৃত জিনিস পড়ে আছে। সেই ঘরে মৌমাছি চাক বেঁধেছে। বিপ্লব দত্ত রোজ ওই চাকটা দেখে আসত গিয়ে। নরম রোদে দাঁড়িয়ে তিথি একটু ভাবল। মরবার আগে বাবার কি মনে হয়নি যে তার তিথি খুব কাঁদবে? তিথির বড় কষ্ট হবে? একটুও ভাবল না বাবা?
কোকিলটা যখন তার আর এক দফা ডাক শুরু করল তখন তিথি টের পেল, সে কাঁদছে।
চোখের জল মুছে দোতলায় উঠে এল তিথি। চায়ের গন্ধ, রুটি সেঁকার গন্ধ, বাসনমাজার শব্দ।
মিলি দত্ত ডাইনিং টেবিলে বসা। সামনে চা।
তিথি মায়ের সামনে কাগজটা রেখে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, এই নাও মা, বাবার সুইসাইড নোট।
মিলি খুব অবাক হয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে বলল, কী এটা! কী বললি?
-বাবার সুইসাইড নোট। পড়ো না।
হাতটা একটু কেঁপে গেল কিনা বোঝা গেল না। মিলি দত্ত কাগজের ভাঁজটা খুলতে একটু সময় নিল। লেখাটা পড়তে প্রয়োজনের চেয়ে সময় আরও অনেকটা বেশি লাগল। তারপর উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, এই তো! কোথায় ছিল এটা? কোথায় পেলি?
-একটা বইয়ের মধ্যে। একা ওটা বুক কেসে তুলে রেখেছিল।
মিলি দত্ত সভয়ে আতঙ্কের সঙ্গে বিপ্লব দত্তের জোরালো হাতের কয়েকটি লাইনের দিকে চেয়ে থেকে অসহায় মুখখানা তুলে তিথিকে বলল, এখন এটা দিয়ে আমরা কী করব? ঠিক তখনই তিথি অনেকদিন বাদে হঠাৎ আবার টের পেল তার মা কী অসম্ভব সুন্দরী! ছোটোখাটো, ক্ষীণাক্ষী এই মহিলাকে এখন মনে হচ্ছে যেন দেবযান থেকে পড়া কোনো অপ্সরা। হ্যাঁ অপ্সরা, দেবী নয়। মিলি দত্তের চেহারায় দেবী-দেবী ভাব নেই। তার সৌন্দর্যে ঝাঁজ আছে, আছে আক্রমণ।
তিথি কাগজটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল, এটা আমার কাছে থাকুক মা। তুমি চা-টা খাও।
সব মহিলারই স্বামী সম্পর্কে কিছু অভিযোগ থাকে। মিলি দত্তেরও ছিল এবং আছে। তিথি জানে তার বাবা শুধু বাবা হিসেবে ছিল দারুণ। টপ গ্রেড। কিন্তু স্বামী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, আত্মীয় হিসেবে, মনিব হিসেবে, কর্মচারী হিসেবে অন্যান্য মানুষের কাছে হয়তো ততটা ভালো ছিল না।