হয়তো তোমাকে দুঃখ দিতে চায়নি। হয়তো ভেবেছিল, টাকা শোধ দিয়ে মর্টগেজ ছাড়িয়ে নেবে।
উঃ, আর কত ভোগ বাকি আছে বল তো! তাহলে এখন কী হবে?
কী হবে তা কেউ জানে না। তিথি একটু চুপ থেকে আস্তে করে বলল, ভাবছ কেন? কিছু একটা আমরা করবই।
কী করবি সেটাই জানতে চাইছি।
জানি না মা। এত তাড়াতাড়ি কি সব ঠিক করে ফেলা যায়?
বাড়ি কার কাছে মর্টগেজ আছে তা জানিস?
জানি। সেইদিন অমিত গুহ বলে যে ছেলেটি এসেছিল ওদের কাছে।
তোকে কে বলল?
অফিসে রেকর্ড আছে।
কত টাকার মর্টগেজ?
সব তোমাকে বলব মা। এখনও অনেক কিছু দেখতে হবে, জানতে হবে।
বুক্কা বলল, লড়তেও হবে। উই শ্যাল ফাইট।
মিলি চুপ করে রইল। সম্ভবত সে ধূসর চোখে তার দাম্পত্য জীবনটা আগাগোড়া দেখতে চাইছিল। একজন খেয়ালি, দায়িত্বজ্ঞানহীন, ঢিলা-প্রকৃতির মানুষ। কেন লোকে কবিতা পড়ে তা ভেবে পায় না মিলি। অকাজের কাজ। বিপ্লব কবিতা পড়ত।
.
১০.
দুবাই! দুবাই! মিডল ইস্ট! পশ্চিম এশিয়া! মরুভূমি! উট! আঙুর! আজান! তেল! টাকা! কেন দুবাই যায় লোকে? এবং ফেরার ঠিক থাকে না?
বাবার অফিসঘরে এসে রোজই বসে তিথি। মাঝে মাঝে তিন ভাই-বোন আসে। মামা আসছে। মা আসছে। কিন্তু কী করতে হবে তা তারা কেউ ভালো বুঝতে পারছে না। ইয়ুল টমসন কোম্পানি অবশ্য একটা চেক দিয়েছে নব্বই হাজার টাকার। গাঁইগুঁই করেনি। আর একটা কোম্পানি বলেছে, সাত দিনের মধ্যে দেবে। বাড়িওলাকে আপাতত ঠেকানো গেছে।
আজ তিথি কম্পিউটার নিয়ে বসেছিল। তার চোখ ফেটে জল আসছিল। সে কম্পিউটারকে ভেদ করবে কী করে? তাকে তো কেউ শেখায়নি? এ কোম্পানিই বা চালাবে কী করে সে? সে চালানোর জন্য দরকার ইঞ্জিনিয়ার, দরকার ভালো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, কো অর্ডিনেশন। তারা সবাই মিলেও মাথামুন্ডু কিছুই স্থির করতে পারছে না, আর লোকটা দুবাই গিয়ে বসে আছে। রোজ অমিতের বাড়িতে ফোন করছে তিথি আর শুনতে পাচ্ছে, দুবাই! দুবাই! ওই শব্দটাই এখন শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে। দুবাই যায় কেন লোকে?
একদিন ফোন করতেই একটা মেয়ে ধরল।
আপনি কি অমিতবাবুর স্ত্রী?
স্ত্রী! অমিতের আবার স্ত্রী হল কবে?
মানে আপনি কি ওঁর কেউ হন?
আমি ওর ছোটো পিসি। আপনি কে?
আমি দত্ত রিলায়েনসের একজন পার্টনার। ওঁকে ভীষণ দরকার।
কবে ফিরবে ঠিক নেই। এলে খবর দেব।
ফোন রাখার পর তিথির শুধু খটকা হতে লাগল, অমিতের আবার স্ত্রী হল কবে থেকে? এ কথাটার মানে কী অমিত গুহ বিয়ে করেনি! অসম্ভব। নিশ্চয়ই বিয়ে করেছে এবং ছেলেপুলে আছে।
দু-দিন পর সে আবার টেলিফোন করল, আচ্ছা অমিতবাবুর স্ত্রী কি বাড়িতে আছেন?
একটা হেঁড়ে গলা বলে, অমিতের স্ত্রী! কীসব বলছেন। সে তো বিয়েই করেনি! আপনি কে বলছেন?
আমি দত্ত রিলায়েন্সের পার্টনার তিথি দত্ত।
ওঃ হ্যাঁ, আপনি তো প্রায়ই ওকে টেলিফোনে খুঁজছেন। কী দরকার বলুন তো!
একটা অফিসিয়াল ব্যাপারে ওঁর একটু হেল্প
আমরা আশা করছি দু-চার দিনে এসে যাবে। আপনাকে ও কী হেল্প করছে বলুন তো! আমি ওর কাকা।
আমাদের বিজনেসের ব্যাপারে আমি ওঁর পরামর্শ নিচ্ছি।
আপনি কি বিপ্লব দত্তের মেয়ে?
হ্যাঁ।
অ। আপনাদের নামে তো একটা নোটিস যাচ্ছে।
নোটিশ! কীসের নোটিশ?
একটা লোনের ব্যাপারে।
হ্যাঁ, জানি।
গত তিন দিন ফোন করেনি তিথি। রোজই অবশ্য তীব্র ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু করেনি। অমিতের বাড়ির লোকেরা তার গলা চিনে ফেলেছে। ফোন করলেই ভাববে আবার ওই মেয়েটা জ্বালাচ্ছে।
তিথি কম্পিউটারের অন্ধকার পর্দার দিকে চেয়ে বসে আছে। ভাবছে। বা কিছুই ভাবছে না। ইচ্ছে করে নয়। মাথার ভিতর দিয়ে হু-হু করে এলোমেলো চিন্তারাশি মেঘের মতো ভেসে যাচ্ছে।
দরজায় একটা টোকা পড়ল। বোধহয় বুক্কা বা সঞ্চারি। কিন্তু মনটা টিকটিক করে উঠল, চলকে উঠল। যদি সে হয়!
দরজা খুলে সে দেখল, সে-ই।
কেন যে অভিমানে তার ঠোঁট কেঁপে উঠল কে জানে! শ্বাস আটকে আসছে, গলা আটকে আসছে, স্খলিত কণ্ঠে সে শুধু বলল, এত দেরি হল কেন?
অমিত অবাক হয়ে তিথির দিকে চেয়ে বলল, আরে! তুমি ওরকম করছ কেন? কাঁদবে নাকি? আরে…
অমিত ভারি বিব্রত হয়ে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে অসহায় ভাব প্রকাশ করল। ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, এত জরুরি তলব কীসের জন্য বলো তো! কী এমন বিপদ হল তোমার?
ততক্ষণে তিথি টেবিলে মুখ নামিয়ে হাতের আড়ালে অঝোরে চোখের জল ফেলছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর!
কী মুশকিল। মেয়েটা কাঁদে কেন? এনিথিং রং?
কোনো জবাব না-পেয়ে অগত্যা একটা চেয়ারে বসে নীরবে অপেক্ষা করতে লাগল অমিত। সে কাজের মানুষ। মেয়েদের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের অবকাশই হয় না। এ মেয়েটার নতুন কোনো বিপদ হল নাকি? তাহলে সেটা বলছে না কেন? ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগল সে। গলা খাঁকারি দিল বার কয়েক। অস্ফুট স্বরে বার দুই বলে উঠল, কী মুশকিল!
অবশেষে তিথি মুখ তুলল, বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর যেমন হয় চরাচর, তেমনই স্নিগ্ধ সজল মুখ। কান্নার কিছু উপকারের দিকও আছে হয়তো।
অমিত একটু উদবেগের গলায় বলে, কী হয়েছে বলবে তো!
–কিছু হয়নি। আপনি এত দেরি করলেন কেন?
অবাক অমিত বলে, আমার তাড়াতাড়ি ফেরার কথা ছিল নাকি? আর আমার দেরি হল বলে তুমি–। ওফ, বাড়িতে পা দেওয়া মাত্র যার সঙ্গে দেখা হয় সে-ই বলে, ওরে অমিত, দত্ত রিলায়েন্সের মেয়ে পার্টনার ফোন করছিল, ভীষণ নাকি জরুরি দরকার! পিসি তো রীতিমতো জেরা শুরু করে দিল, বয়স কত, দেখতে কেমন ইত্যাদি। কী বিপদ বলো তো! রোজ ফোন করতে নাকি?