কে টেনে তুলবে বলুন।
অমিত হাত উলটে একটা অসহায় ভঙ্গি করে বলে, সেটা তোমার ব্যাপার। তুমি বুঝবে। ইচ্ছে করলে তুমি কাউকে অ্যাপয়েন্ট করতে পার, ইচ্ছে করলে নতুন পার্টনার নিতে পার।
আমি! আমি কী করে করব?
অমিত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তবে যে বড় চোদ্দো বছরের মেয়ে বলায় রাগ করছিলে?
সে তো ঠিকই করেছি। কিন্তু আমি কাউকে অ্যাপয়েন্ট করব কী করে? কোম্পানি তো বাবার।
অমিত একটু অবাক হয়ে বলে, তুমি তো এ কোম্পানির একজন পোটেনশিয়াল শেয়ারহোল্ডার অ্যাণ্ড পার্টনার।
আমি! সে কী?
অমিত ফের কম্পিউটারের কয়েকটা চাবি টিপল। পর্দায় একটা এগ্রিমেন্টের ছবি ভেসে উঠল। অমিত বলল, এসো, দেখে যাও।
ভীরু, দ্বিধাজড়িত পায়ে এগিয়ে গেল তিথি। পর্দার দিকে চেয়ে সে ছবিটা দেখল, কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না।
অমিত একটা পেনসিলের ডগা একটা ডটেড লাইনের ওপর রেখে বলল, এটা তোমার নাম, দেখতে পাচ্ছ?
তিথি দেখতে পেল।
অমিত বলল, এ ভেরি লিগালাইজড ডকুমেন্ট। তুমি আর বিপ্লব দত্ত পার্টনার।
তিথি হাঁ করে রইল বিস্ময়ে। বলল, বাবা কখনো বলেনি তো আমাকে।
বলেনি! কিন্তু তোমার সই রয়েছে যে!
সই! একটু ভেবে তিথি বলল, অনেকদিন আগে বাবা একটা কাগজে সই করতে বলেছিল। সেটাই কি এটা?
অনেকদিন বলতে তেমন বেশি দিন নয় কিন্তু, মাত্র একবছর আগে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই হবে। আমি সত্যিই এই কোম্পানির পার্টনার?
না, এখন আর পার্টনার নও।
তিথির মুখ শুকনো, এই যে বললেন।
কী বললাম? আচ্ছা বোকা মেয়ে তো! চোদ্দো বছরের খুকি, তোমার বাবা যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন তুমি পার্টনার ছিলে বটে।
এখন আর নই?
না। কারণ এখন তুমিই এই কোম্পানির মালিক।
তিথি ঝলসে উঠল, মালিক! ইউ মিন প্রপাইটর?
হ্যাঁ, তবে এ সিংকিং কোম্পানি। টেনে তোলা যায়, কিন্তু বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে। খাটুনি আছে।
তিথি চারদিকে অবাক চোখে চেয়ে দেখল, এসব আমার!
বিরক্ত অমিত বলল, অত উতলা হওয়ার কী আছে? এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখো। আজ বেশ রাত হয়ে গেছে। আজ আর কিছু হবে না। তুমি কাল একটু বেলাবেলি চলে এসো। দরজার গায়ে ওই যে মস্ত লেটারবক্স ওটা খুলে দেখো কোনো চিঠিপত্র এসেছে কিনা। বিশেষ করে দেখবে চেক। কয়েকটা পেমেন্ট তুমি পেয়ে যাবে। ড্রয়ার, ক্যাবিনেট এগুলোও ভালো করে সার্চ করবে। মনে হচ্ছে কম্পিউটারে আরও ইনফর্মেশন ভরা আছে। সেগুলোও দেখা দরকার।
কাল আপনি আসবেন না?
আমি! আমি কেন আসব?
আমি যে এসব কিছুই বুঝি না।
বোঝবার কথাও নয়। আমি বলি কি, তুমি তোমার মামার হেল্প নাও।
মামা তো কেবল সব বেচে দেওয়ার কথা বলে। মামা কিছুতে কোম্পানি চালাতে দেবে না।
চালানো সহজও নয়।
তাহলে কী হবে?
অমিত ঘড়ি দেখে বলল, আমার একটা জায়গায় আজ রাতেই যেতে হবে। সময় নেই। এসব নিয়ে পরে কথা হবে।
পরে মানে কবে?
এসো, আমার গাড়ি আছে। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু কোম্পানি?
একটু ভাবতে দাও। বলব।
দায়িত্ব নিচ্ছেন তো।
না। দায়িত্ব নয়। আমার ভূমিকা হবে অ্যাডভাইজারের। তার বেশি কিছু নয়।
বাঃ রে, আমি সবে একটা কোম্পানির মালিক হলাম, আর আপনি আমার উৎসাহে জল ঢেলে দিচ্ছেন।
আমার তো খুব বেশি কিছু করার নেই তিথি। তবে তুমি ঘাবড়ে যেও না। চেষ্টা করলে পারবে। তোমাদের তিনটে বিল-এর সন্ধান পাওয়া গেছে। ওটা আদায় হলে আপাতত কোম্পানি বেঁচে যাবে। মনে হয় আনরিয়ালাইজড আরও কয়েকটা বিল-এর খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। তবে আদায় করা শক্ত।
মৌলালি থেকে সল্ট লেক–তিথিকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার পথে গাড়ি চালাতে চালাতে খুব কম কথাই বলল অমিত। তাকে ভীষণ গম্ভীর আর অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। লোকটাকে কেমন ভয়-ভয় লাগছিল তিথির। গতকাল ধুতি পাঞ্জাবি পরা নার্ভাস, কুণ্ঠিত, ভীতু যে লোকটাকে দেখেছিল এ তো সে নয়। পোশাক পালটালে কি লোকের ব্যক্তিত্ব পালটে যায়? নাকি এ লোকটা নানারকম রোল-এ অভিনয় কয়তে পারে।
লোকটা এমনকি ভালো করে একটা বিদায় সম্ভাষণও জানাল না তিথিকে নামিয়ে দেওয়ার পর। শুধু দায়সারা ভাবে বলল, চলি। এবং চলে গেল।
তিথিকে পাত্তা দিল না। একদম পাত্তা দিল না। আট মাস আগে সে চোদ্দো পূর্ণ করেছে। বয়স কম নয়। তবু পাত্তা দিল না একদম।
৯-১১. রাতে খাওয়ার টেবিলে
রাতে খাওয়ার টেবিলে বুক্কা বলল, তিথি একটা কোম্পানির মালিক, আমাদের এ ঘটনাটা সেলিব্রেট করা উচিত মা।
মিলি তার স্থায়ী কোঁচকানো ভ্রূ তুলে বলে, সেলিব্রেট। আমাদের সেলিব্রেট করার মতো কিছু তো নয়? কে কোম্পানি চালাবে? বাড়িওয়ালা নাকি মামলা করবে। অনেকদিনের ভাড়া বাকি।
সঞ্চারি বলল, দেয়ার ইজ হোপ এগেনস্ট হোপ। আমাদের তিন ভাইবোন যদি একসঙ্গে চেষ্টা করি?
মিলি কঠিন চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে বলে, আর পড়াশুনো?
বুক্কা বলে, পড়াশুনো করে কী হবে মা? আগে তো আমাদের সারভাইভাল।
মিলি বলে, আমাদের চলে যাবে। বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলে ঠিক চলে যাবে।
বজ্রাঘাতের ইচ্ছে ছিল না তিথির। কিন্তু তবু কথাটা না-বলেও পারল না, বাড়ি বিক্রি হবে না মা। এ বাড়ি মর্টগেজে আছে।
মর্টগেজ! তোকে কে বলল?
আছে মা। আমি খবর পেয়েছি। সেইজন্যই ওরিজিন্যাল দলিল আমাদের কাছে নেই।
তোর বাবা তো কখনো আমাকে বলেনি সে-কথা!