মিলি মেয়ের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি এসো। নইলে ভাবব। আজকাল আমার অল্পেই ভীষণ টেনশন হয়।
বিকেলে যখন বিপ্লব দত্তের অফিস-বাড়িতে একাই পৌঁছে গেল তিথি তখন শীতের ঘোর সন্ধ্যে। ল্যাণ্ডিং-এ একজন সুট পরা লোক দাঁড়িয়ে। বেশভূষার পার্থক্যে লোকটিকে এত অন্যরকম লাগল যে প্রথমে চিনতেই পারেনি তিথি।
আমি দশ মিনিট অপেক্ষা করেছি মাত্র। তুমি খুব টাইমলি এসেছ!
তিথি লোকটাকে তখন ভালো করে দেখল, ওঃ আপনি! বাঁচা গেল। একা একটা অচেনা বাড়িতে ঢুকে ভয়-ভয় করছিল। কেউ যদি চোর বলে ভাবে!
চোরেরা অন্যরকম হয়, তারা তোমার মতো হয় না।
লোকটাকে দেখতে বেশ। একটু যেন নার্ভাস, একটু যেন সরল, আবার যেন মিটমিটে দুষ্টুমি বুদ্ধিও আছে।
বিপ্লব দত্তের অফিস-ঘর খুলে যখন আলো জ্বালালো তিথি তখন চারদিকটা ঝলমল করে উঠল। বোধহয় ভালো ইন্টিরিয়র ডেকরেটরকে দিয়ে সাজিয়েছিল তার অফিস-ঘর বিপ্লব দত্ত। আসল সেগুন কাঠের প্যানেল করা ঘর, ক্যাবিনেট, সেগুন কাঠেরই অত্যাধুনিক টেবিল এবং ভালো জাতের গদিওয়ালা চেয়ার।
এয়ারকুলার বসানো ঘরটা একটু ভেপসে আছে। অমিত কুলারটা চালু করে দিল। একদিকে আলাদা কম্পিউটার টেবিল। যন্ত্রটা প্লাস্টিকের ঢাকনা দেওয়া।
অভ্যস্ত দক্ষ হাতে অমিত কম্পিউটার চালু করল। টেবিলের টানায় পাওয়া গেল কম্পিউটারের তথ্যাবলি। অমিত সম্পূর্ণ মগ্ন হয়ে যন্ত্র নিয়ে মেতে গেল। তিথি তার বাবার চেয়ারটায় গিয়ে বসল। লোকটা তাকে এত তাচ্ছিল্য করছে কেন? চোদ্দো বছর বয়সটা কি এতই তাচ্ছিল্য করার মতো? তার বুঝি বয়স হবে না?
প্রায় আধঘণ্টা একনাগাড়ে একটার পর একটা তথ্য খুঁটিয়ে দেখল অমিত। একটাও কথা বলল না, একবারও ফিরে তাকাল না। লোকটা কাজ-পাগল নাকি?
আধঘণ্টা বাদে অমিত চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে একটা বড়ো শ্বাস ছাড়ল।
তিথি ব্যগ্র গলায় বলল, কী দেখলেন?
অমিত ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলে, কিছু আশাব্যঞ্জক পাওয়া যায়নি এখনও। আরও একটু দেখতে হবে।
দেখুন, আমি বসছি। আপনার দুবাই যাওয়ার কী হল?
আজ হচ্ছে না। সাত দিন পরে যেতে হবে।
মনে মনে কেন খুশি হল তিথি? এ লোকটা দুবাই না-গেলে তার কী এমন উপকার হবে? ভ্রূ কুঁচকে ব্যাপারটা একটু ভাবতে চেষ্টা করল সে। লোকটা আবার কম্পিউটার নিয়ে মগ্ন হয়ে গেছে।
কাল টেলিফোনে আপনি আমাকে চোদ্দো বছরের মেয়ে বলে ডেকেছিলেন কেন?
দাঁড়াও। সামথিং ইজ কামিং আপ।
আমি কিন্তু আপনার ওপর একটু রেগে আছি।
অমিত কোনো জবাব দিল না। পলকহীন চোখে চেয়ে রইল কম্পিউটারের পর্দার দিকে।
শুনেছেন! আমি কিন্তু রাগ করেছি।
এটা একটা আনরিয়ালাইজড বিল দেখছি! সামান্য উত্তপ্ত গলায় বলে অমিত। বিল!
কীসের বিল!
তুমি বুঝবে না। একটু চুপ করে বোসো তো!
ধমকাচ্ছেন! এমনিতেই আমার মন খারাপ।
প্লিজ! হোল্ড ইওর টাং ফর এ মিনিট। অ্যানাদার বিল। চেক বাউন্স করেছিল। কেস কোর্টে।
আমাকে কম্পিউটার হ্যাণ্ডলিং শিখিয়ে দেবেন?
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। লোকটার বাহ্য চৈতন্য নেই।
চুপচাপ একটা বন্ধ ঘরে কাঁহাতক বসে থাকবে তিথি। সে হাতের কাছে একটা বেশ ঝকঝকে পুশ বাটন ফোন দেখে বন্ধু রাকাকে ফোন করল। তরল আলাপ।
রাকা, বল তো কোথা থেকে ফোন করছি!
কোত্থেকে রে? বাড়ি?
পারলি না। বাবার অফিস থেকে। ঘ্যাম অফিস।
ও মা! সেখানে কেন?
কাজ আছে। আমরা একটা কম্পিউটার বাস্ট করছি।
আমরা মানে! তোর সঙ্গে কে?
একজন কম্পিউটার এক্সপার্ট। একটু গোমড়ামুখো।
অমিত একটা ধমক দিল, একটু নীচু গলায় কথা বলো। আমি মোটেই গোমড়ামুখো নই।
রাকা সভয়ে বলল, কে রে?
চাপা গলায় তিথি বলল, ওই লোকটা।
তোকে ধমকাচ্ছে কেন?
জোরে কথা বলছি বলে।
রাকা খিলখিল করে হাসল, ও বাবা, দারুণ রাগী তো। কম্পিউটারটা কি তোদের?
ছিল তো আমাদেরই। এখন কী হবে কে জানে। তুই তো ইনসাইড স্টোরি জানিস। শুনছি বাবার অনেক লায়াবিলিটিজ। কিছুই থাকবে না। কিন্তু আমার বাবার অফিসটা যদি তুই দেখতিস! ফ্যান্টাস্টিক। ছোটোর মধ্যে দারুণ সাজানো, আসবি একদিন?
গিয়ে কী হবে?
আরও দু-চারজনকে জুটিয়ে দারুণ আড্ডা। ওপাশের ফুটে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। বললেই চা-খাবার সব দিয়ে যাবে।
এ গুড আইডিয়া।
অমিত ফের মৃদু শাসনের স্বরে বলে, আস্তে। আমার কনসেনট্রেশন নষ্ট হচ্ছে।
এই রাকা, ছাড়ছি রে। পরে কথা বলব।
কাল চলে আয় না।
আচ্ছা দেখব।
তোর কম্পিউটার এক্সপার্টের বয়স কত রে?
তা আছে। নিয়ারিং থার্টি।
ওঃ হেল। আরেকটু কম হলে–হ্যাণ্ডসাম?
মন্দ নয়। বলেই ফোনটা রেখে দিল তিথি। তার হঠাৎ মেজাজটা খিঁচড়ে যাচ্ছে কেন? কেনই-বা বুকটা দুরদুর করছে? তিথি চুপ করে পাথর হয়ে বসে রইল। টিকটিক, টিকটিক, সামথিং রং?
অনেকক্ষণ কম্পিউটারটাকে ব্যবহার করে অমিত চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। তারপর একটা ক্লান্তিসূচক শব্দ করল, হাঃ।
তিথি পেছন থেকে ওকে দেখছিল। স্থির চোখে।
অমিত রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে তিথির দিকে তাকিয়ে বলে, লায়াবিলিটি আছে, ধারও আছে, বকেয়া আছে অনেক পেমেন্ট। তবু আমি ভাবছি এ কোম্পানি চালু করা যায়।
কীভাবে?
আর মাত্র হাজার পঞ্চাশেক টাকা ঢাললেই। অবশ্য টাকা ঢাললেই হবে না। ইট নিডস এ গুড ম্যানেজমেন্ট। বুদ্ধি আর ধৈর্য থাকলে কোম্পানিকে টেনে তোলা যাবে।