তোমাকে নিয়ে আর পারি না। এখন অগোছালো ঘর আবার আমাকে গোছাতে হবে। দেখো তো কী কাজ বাড়ালে আমার।
আহা তোকে কেন গোছাতে হবে। কাল সকালে একাদশী এসে গুছিয়ে দেবে।
একাদশীর কথায় হঠাৎ তিথির একটা কথা মনে পড়ে গেল। সে বলল, হ্যাঁ বাবা জান, তোমার সেই সুইসাইড নোটটা পাওয়া গেছে। কী পাগল বলো তো তুমি।
কোথায় পেলি?
তুমি তো ওল্ড পোসামস বুক অফ প্র্যাকটিক্যাল ক্যাটস, বইটার মধ্যে গুঁজে রেখেছিলে। একাদশী বই তুলে রেখেছিল বুক-কেসে। তারপর একদিন…আচ্ছা বাবা, তুমি একটা কী বলো তো! ওরকম করলে কেন?
বিপ্লব দত্ত ম্লান একটু হাসল, কী করলাম?
সুইসাইড করতে গেলে কেন?
ওঃ, সে একটা ব্যাপার আছে।
সবাই যে তোমার নিন্দে করছে। বলছে লোকটার একদম দায়িত্ববোধ ছিল না।
ঠিকই বলে রে, ঠিকই বলে। কী যে সব গন্ডগোল পাকিয়ে ফেললাম!
মায়ের সঙ্গে তোমার বনিবনা হত না, তাই?
বউ একটা ফ্যাক্টর। ভীষণ ফ্যাক্টর। বউরা বোঝেই না যে তারা কীভাবে একজন পুরুষকে প্রতিদিনকার নির্দয়তা দিয়ে, শোষণ দিয়ে, অবহেলা দিয়ে মেরে ফেলে।
ওসব কথা থাক বাবা। জান তো, তোমাদের দুজনের ঝগড়া হলে আমার মন খারাপ হয়।
আমারও হত। যখন আমার মা-বাবার ঝগড়া হত। ওফ, মনে হত, আমি মরে যাই না কেন।
তাহলেই বোঝো।
বিপ্লব দত্ত মাথা নেড়ে বলে, বুঝি না, কিছু বুঝি না। এই যে বাড়িটা বানাতে এত টাকা ধার করতে হল, ব্যবসা করতে গিয়ে মার খেতে হল, এসব কার জন্য বল তো!
মায়ের জন্য?
একজ্যাক্টলি। আমাকে তিষ্ঠোতে দিত না। কেবল বড়োলোক হতে বলত। কেবল…যাকগে, তুই তো পছন্দ করিস না।
তুমি মরতে গেলে কেন বাবা! আমার যে সব আনন্দ চলে গেল।
ভুলে যাবি। সবাই ভোলে। কোনো শোক কি চিরস্থায়ী হয়?
আর আমাদের অবস্থাও দেখো। কত গরিব হয়ে গেছি আমরা।
বিপ্লব দত্ত তার চেয়ারে বসে লম্বা চুলে অস্থির আঙুল চালাতে চালাতে বলে, তোমরা কোনোকালে বড়োলোক ছিলে না। বড়োলোকি করেছো অ্যাট দি কস্ট অফ এ ম্যান। এবার তার গুনাগার দিতে হবে।
তুমি এমন নিষ্ঠুর কথা বলতে পার?
পারি। আমি এক নিষ্ঠুরতারই শিকার। দ্যাট বীচ, দ্যাট লিটল উওম্যান…ওফ, আবার বলতে যাচ্ছিলাম।
তিথির চোখ ভরে জল এল।
বিপ্লব দত্ত অস্থিরমতির মতো উঠে ঘর জুড়ে সিংহবিক্রমে পায়চারি করতে করতে বলে, কাঁদিস না। আমি ছেলে-মেয়ের চোখের জল সইতে পারি না।
তুমি আমাদের এত ভালোবাসো বাবা, আর মাকে পারলে না?
এ কোশ্চেন অফ রেসিপ্রসিটি। যাকগে। আমি ও নিয়ে অনেক ভেবেছি। কার দোষ কে বলবে? জন্মানোটই দোষ, বেঁচে থাকাটাই দোষ।
তাহলে কি আত্মহত্যাই ভালো বাবা?
না না। একদম ভালো নয়। আই ফিল লোননি। ভেরি লোনলি। কেউ নেই যেন, কিছু নেই যেন, অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা। ঘুম নেই, জেগে ওঠা নেই, খিদে পায় না, তেষ্টা পায় না। বড্ড বোরিং।
তুমি কেন বোজ আসো না বাবা।
রোজ আসি। রোজ। তোদের ডিস্টার্ব করি না।
আমাদের কী হবে বলো তো বাবা?
কে জানে! কত লোক তো আছে। তাদের কী হয়? অত ভাবিস কেন?
আমাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। বাড়ি বিক্রি হবে।
বাড়ি! ইট কাঠ পাথর! ও দিয়ে কী হয়!
আমরা যে বাড়িটাকে ভীষণ ভালোবাসি বাবা!
বাড়িকে! দূর পাগলি, বাড়িকে ভালোবাসবি কেন? মানুষগুলোকে বাস। তবে বাড়িটা বাড়ির মতো হবে। এবাড়ির জন্যই না আমার এত লাঞ্ছনা, অপমান, এত কষ্ট, এত…এত…
বাবা, অত অস্থির হচ্ছ কেন?
এবাড়িটা…এর জন্য আমাকে নিংড়ে দিতে হয়েছে। …টাকা গেল, প্রেস্টিজ গেল, প্রাণটা অবধি…তিথি!
কী বাবা?
সুইসাইড নোটটা কোথায়?
আমার কাছে আছে। দেব?
দে তো।
তিথি নোটটা বের করে দিল।
বিপ্লব দত্ত সেটা পড়ে মাথা নেড়ে বলল, কত কথা এখানে লেখা নেই। কত কথা লেখার ছিল! এটা একটা বোগাস জিনিস। আসল সুইসাইড নোট হবে উপন্যাসের মতো বিরাট জিনিস। তাতে সব কথা থাকবে। কী করে একটা লোক অবধারিত মৃত্যুর দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আসলে তাকে ঠেলে দিচ্ছে কিছু লোক, কিছু কারণ, কিছু পরিস্থিতি। খুব জটিল, বুঝলি?
বুঝলাম না বাবা। তবে তুমি সুইসাইড করার পর আমারও কয়েকবার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়েছে।
দূর পাগলি! তুই কেন মরবি? কোনো মজা নেই।
মরে তোমার কাছে তো যেতে পারব।
বিপ্লব দত্ত মাথা নাড়ে, না। মরে কেউ কারো কাছে আসতে পারে না। দেখছিস না আমি কেমন একা! বোরিং। অ্যাবসোলিউটলি বোরিং।
ধূপকাঠি নিবে গেলে যেমন গন্ধের রেশ থেকে যায়, মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে বাবার উপস্থিতির একটা রেশ যেন টের পেল তিথি। স্বপ্ন স্বপ্নই। ভূতে সে কখনো বিশ্বাস করেনি। তবু অন্ধকারে সে স্বপ্নটার স্মৃতি উপভোগ করছিল। অন্তত স্বপ্নেও তো এসেছিল বাবা! সে উঠে বাতি জেলে বিপ্লব দত্তের অব্যবহৃত একটা ডায়েরি খুলে তারিখ আর সময়সহ স্বপ্নের একটা বিবরণ লিখে রাখল। স্বপ্নের কথা মনে থাকতে চায় না বলেই লিখল। এ স্বপ্নটা সে ভুলতে চায় না।
.
০৮.
সকালে ব্রেকফাস্টের সময় তিথি বলল, মা, আজ আমার স্কুল থেকে ফিরতে অনেকটা দেরি হবে।
কেন, কোথায় যাবি?
বাবার অফিসে। অফিসের চাবিটাও নেব।
সেখানে কী আছে?
একবার যাব। দেখব।
কে নিয়ে যাবে তোকে?
তিথি একটু হেসে বলে, শোনো মা, এখন কিন্তু আমাদের মাথার ওপরে কেউ নেই। তাই না? আমাদের কেউ কোথাও নিয়ে যাবে না। এখন থেকে আমাদের একা-একাই যেতে হবে। একটু তাড়াতাড়ি সাবালকও হয়ে উঠতে হবে। হার্ড ডেজ অ্যাহেড।