সুইমিং পুল?
অবাক হওয়ার কিছু নেই। শেখদের অনেক টাকা। তারা বাকিংহাম প্যালেসও কিনতে চেয়েছিল একবার। চোদ্দো বছরের মেয়ে, তুমি এখনও পৃথিবীর কত কী জান না!
হঠাৎ কেন চোদ্দো বছরের খোঁটা দিলেন বলুন তো!
ভাবছি তুমি কত ছোটো। পৃথিবী তোমার কাছে কতই না কঠিন হয়ে উঠেছে! তোমার এখন আনন্দের বয়স, ফুর্তির বয়স। এই বয়সে কোনো মেয়ের এরকম সমস্যা আর দুশ্চিন্তায় পড়া উচিত নয়।
তিথি একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, বাবার সঙ্গেসঙ্গেই আমার সব আনন্দ চলে গেছে। টাকা নয়, আরাম বা বিলাসিতাও নয়। বাবাই ছিল আমার আনন্দের সবচেয়ে বড় কারণ।
বুঝেছি।
আচ্ছা, আপনি কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানেন?
জানি। কেন?
আমি জানি না।
শিখবে?
খুব তাড়াতাড়ি কি শেখা যায়?
না। একটু সময় লাগে।
তাহলে লাভ নেই।
সব শিক্ষারই একটা বাড়তি সুবিধে আছে। মানিটারি ওয়ার্ল্ডে কখন যে কাকে দরকার হয়।
চাকরির জন্য নয়।
তাহলে?
শুনেছি আমার বাবার অফিসে একটা কম্পিউটার আছে। তাতে বাবা কোন ডাটা ভরে রেখেছে তা জানতে ইচ্ছে করে।
খুব অবাক হয়ে অমিত বলে, তোমার বাবার কম্পিউটার ছিল নাকি? জানতাম না তো!
কম্পিউটারটা এখনও আছে, যদি-না বাড়িওয়ালা তালা ভেঙে জিনিসপত্র সরিয়ে দিয়ে থাকে।
না, তা দেবে না। তাহলে কেস হয়ে যাবে ট্রেসপাসিং-এর জন্য। তোমার ইনফর্মেশনটা নতুন। কম্পিউটারটা আমারও দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কালই আমাকে বোধহয় দুবাই যেতে হবে।
আপনার কাজটা বেশ, তাই না? আজ এখানে, কাল সেখানে।
যত মজার বলে মনে হচ্ছে তত মজার নয়, কিন্তু কাজ নিয়ে যাদের ঘুরতে হয় তাদের বেড়ানোটাও হয় কাজের মতো। একবার আফ্রিকায় একটা জলপ্রপাত দেখতে গিয়েছিলাম। গিয়ে সারাক্ষণ কী করলাম জান? শুধু ক্যালকুলেট করলাম। কীভাবে জলটাকে বেঁধে একটা বেসিন তৈরি করে চমৎকার একটা হাইডেল-প্রোজেক্ট বানানো যেত! হিসেব কষতে কষতে জলপ্রপাতটার সৌন্দর্য লক্ষই করলাম না। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধানই ভানে। বুঝলে?
বুঝলাম। আপনার সঙ্গে টেলিফোনেই আমার বেশ ভাব হয়ে গেল দেখছি।
টেলিফোন জিনিসটা অতিচমৎকার। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ইকুইপমেন্ট।
কম্পিউটার তাহলে কাল হচ্ছে না? কবে ফিরবেন?
দাঁড়াও। আমার যাওয়াটা কিছু অনিশ্চিত। ওখান থেকে একটা ট্রাঙ্ক কল বা ফ্যাক্স মেসেজ আসার কথা। এলেই বুঝতে পারব যাওয়ার কতটা দরকার। বিপ্লববাবু হঠাৎ একটা কম্পিউটার কিনলেন কেন জান?
না। বোধহয় বড়ো বিজনেস করবেন বলে।
আমাদের দেশে কম্পিউটারের দিকে মানুষকে আকৃষ্ট করার একটা কায়দা হয়েছে দেখেছ? কথায় কথায় কম্পিউটার দেখাচ্ছে। কম্পিউটারে নাকি প্যাথলজির পরীক্ষা হয়, কম্পিউটারে চোখ পরীক্ষা হয়, কম্পিউটারে ভাগ্যগণনা অবধি হচ্ছে। সব বোগাস। বোঁদা কম্পিউটারগুলো আসলে ডাটা ব্যাংক। ইনফমেশন স্টোর করা ছাড়া আর র্যাণ্ডম অ্যাকসেস দেওয়া ছাড়া কী করতে পারে বলো তো।
আমি কিন্তু কম্পিউটারের কিছুই জানি না।
ঠিক আছে, কাল দুবাই গেলেও আমি তো যাব রাতের প্লেনে। দিনের বেলা একটু সময় করে নেওয়া যাবে। অফিসের চাবি কি তোমাদের কাছে আছে?
আছে।
তাহলে আমি কাল সকালে তোমাকে ফোন করব।
আমাদের ফোন খারাপ। আমি বন্ধুর বাড়ি থেকে ফোন করছি আপনাকে।
তাহলে?
কাল আমার স্কুলও আছে।
স্কুল কখন ছুটি হয়?
সাড়ে চারটের।
ও কে। স্কুল থেকে সোজা তোমার বাবার অফিসে চলে এসো।
.
০৭.
বিপ্লব দত্তের ভূত জেগে উঠল মধ্যরাতে। প্রথমে বাতাসের মধ্যে একটু ফিসফাস। তারপর অন্ধকারে একটু মন্থন। আবহ গাঢ় ঘনীভূত হয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠল একটা অস্তিত্ব। শরীর নয়, যেন দীর্ঘশ্বাস আর গভীর অনুভূতি দিয়ে তৈরি এক অস্পষ্ট উদ্ভাস। সে নেই, তবু আছে।
বিপ্লব দত্তের ভূত ছাদ থেকে ধীরে নেমে এল দোতলায়। এক ঘরে তার মেয়ে এবং বাড়ির পরিচারিকা। অন্য ঘরে তার স্ত্রী এবং ছেলে। বিপ্লব দত্ত এক তীব্র আকুলতা নিয়ে লক্ষ করল তাদের। ফিসফিস করে বলল, ছিল, ছিল, সব ছিল।
মিলি পাশ ফিরল অস্বস্তিতে। ঘুমের মধ্যে সঞ্চারি বলে উঠল, উঃ মা গো!
বুক্কা মাথা চুলকালো, একটু ছটফট করল।
বিপ্লব দত্ত ধীরে ভেসে ভেসে কাটা ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে নীচে নেমে এল।
এই তার ঘর। তিথি ঘুমে নিঝুম। বিপ্লব দত্ত চারদিকে ভেসে বেড়াতে লাগল। কিছু অস্থির, উদভ্রান্ত। তার বই, তার চেয়ার, তার বিছানা, চারটে দেয়াল, দক্ষিণের জানালা, সামনের বাগান কিছুই এখন তার আর দরকার হয় না। তখন এক দীর্ঘশ্বাসই যেন বলে উঠল, ছিল, ছিল, সব ছিল…
ও কি বিপ্লব দত্ত? না কি এ শুধু তার অস্থিরতা, তার জ্বালা তার উদবেগও অপূর্ণতারই এক ঘনক!
বিপ্লব দত্তের ভূত বাগানে গেল। আকাশের দিকে চেয়ে তার দীর্ঘশ্বাস বলতে লাগল, ছিল…নেই…ছিল…নেই…
তিথি আজ প্রথম তার বাবাকে স্বপ্ন দেখল। বাবা যে মারা গেছে এটা তার মনেই হল না। বাবা দিব্যি তরতাজা। ঘরের মধ্যে বাবা কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। পাচ্ছে না। হাঁটকাচ্ছে টেবিল, বইয়ের শেলফ, তাক।
উঃ বাবা, কী যে করছ ঘরটাকে! কী খুঁজছ বলবে তো।
খুঁজছি! হ্যাঁ, কী যেন।
কী খুঁজছো তাও জান না?
জানি। কিন্তু কী যে হয় মাঝে মাঝে হঠাৎ এইমাত্র ভুলে গেলাম। যেই তুই জিজ্ঞেস করলি অমনি ভুলে গেলাম।