যদি আমরা আরও একটু সময় চাই, দেবেন?
সময় নিয়ে কী করবে? টাকা শোধ!
যদি চেষ্টা করি?
অমিত এ কথায় খুব গলা ছেড়ে অট্টহাসি হেসে উঠতে পারত। হাসিরই কথা। তিথিও টের পাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, অমিত হাসল না। বরং খুব সিরিয়াস গলায় বলল, যত সময় নেবে তত চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়বে। এই কারবারে টাইম ইজ মানি। ভেবে দেখো। টাকাটা কম হলে সুদ গায়ে লাগে না, কিন্তু বিগ অ্যামাউন্ট মানে সুদও অনেক। পারবে?
চেষ্টা করতে দোষ কী? পার্ট বাই পার্ট যদি দিই?
এসব অ্যামাউন্ট পার্ট বাই পার্ট দিয়ে সুবিধে নেই। যা শোধ করবে পরের বছর সুদে আসলে আবার ব্যাক টু দি স্কোয়ার ওয়ান হয়ে যাবে। বাঁদরের অঙ্ক কষোনি, তিন হাত ওঠে তো দু-হাত নামে! এখানে তিন হাত উঠলে তিন হাতই নেমে যেতে হবে। লাভ হবে না তিথি।
তাহলে আমরা কী করব? বাড়ি বিক্রি করে যদি–?
বাড়ি বিক্রির প্রশ্ন ওঠে না। ওটা যে বাঁধা আছে। তোমার মামা জানতেন না বলে বিক্রির চেষ্টা করছিলেন।
আমরা খুব গরিব হয়ে গেছি, তাই না?
না, তা কেন?
আজও আমাদের বাড়িতে মুর্গির মাংস হয়েছিল। দু-দিন পর থেকেই হয়তো শুধু ডালভাত।
না, তোমরা এখনও ততদূর গরিব নও। আরেকটা কথা হল, বিপ্লববাবুও কিন্তু কখনোই বড়োলোক ছিলেন না। তবে উনি বড়োলোকদের মতো থাকতে ভালোবাসতেন।
আচ্ছা আপনারা বোধহয় খুব রিচ, তাই না?
আমি নই। তবে আমার বাবা-কাকারা ঝানু ব্যবসাদার।
আপনাদের কি সুদের কারবার?
অমিত সামান্য হেসে বলে, তা কেন? আমাদের রোলিং মিল আছে, স্প্রিং তৈরির কারখানা আছে, ডিস্ট্রিবিউটরশিপ আছে, আবার একটা ফিনানসিয়াল চিট ফাণ্ডও আছে।
আমার বাবা কোনোদিন টাকাকে টাকা বলেই মনে করল না। তবু আমি কিন্তু আমার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি।
মনে আছে উনিও তোমার কথাই বেশি বলতেন।
বলতেন? কী বলতেন?
তুমি যে বাবাকে ভীষণ ভালোবাসো এই কথাটাই বলতেন।
হ্যাঁ, বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু আমার বাবার কয়েকটা ড্র-ব্যাক ছিল সেটা অস্বীকার করি না।
ড্রব্যাক আমাদের সকলেরই আছে।
আচ্ছা দেউলিয়া বলে একটা কথা আছে না? আমরা কি তাই এখন?
না, এখনও নও। তোমাদের মস্ত অ্যাসেট ওই বাড়িটা। বিপ্লববাবুর অবশ্য একটা কনসালটেন্সি ছিল। সেটার কী অবস্থা জানি না অবশ্য।
খুব খারাপ। বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে। আরও কী কী সব যেন। বোধহয় লায়াবিলিটিজ অনেক বেশি।
তবু একটু খোঁজ নিতে বোলো তোমার মামাকে কোথাও কোনো বিল ওঁর ডিউ হয়েছে কিনা।
বলব।
অবশ্য সাকসেশন সার্টিফিকেট না-পেলে তোমরা কিছুই ক্লেম করতে পারবে না।
আচ্ছা, এমন কথাও তো কেউ ভাবতে পারে যে আমার বাবা টাকার প্রবলেমে পড়েই সুইসাইড করেছে।
ভাবাটাই স্বাভাবিক।
আর সেই প্রবলেমের জন্য আপনারাও খানিকটা দায়ী!
অমিত সামান্য হাসির শব্দ করল, রাগল না। বলল, আদালত অবশ্য তা বলবে না। এ হল ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ। তবে তোমার কথাটা মর্যালি আমি মানছি। বিপ্লববাবু যদি টাকার চিন্তায় আত্মহত্যা করে থাকেন তবে তাতে খানিকটা পরোক্ষ ইন্ধন আমাদেরও ছিল। কিন্তু তুমি এই পয়েন্টটায় বেশি জোর দিও না।
না, আমি এমনি বললাম। দোষ তো আমার বাবারই।
তুমি একটা কাজ করো। তোমার বাবার ঘরে খুঁজলে কিছু কাগজপত্র পাবে। আমাদের কাছ থেকে উনি যে টাকা নিয়েছিলেন তার কিছু দলিলপত্রের কপি। ওতে আসল টাকা আর রেট অফ ইন্টারেস্ট আছে। বাড়িতে ক্যালকুলেটর থাকলে তাতে হিসেব করে নিতে পারবে। ওঁর লোন-এ প্রতি তিনমাস অন্তর ইন্টারেস্টটা লোন অ্যামাউন্টে যোগ হত, আরও তিন মাস পর সেই অ্যামাউন্টের ওপর সুদ হয়ে সেটা আবার আসলে যোগ হত। বুঝলে?
ইস, সে তো সাংঘাতিক ব্যাপার।
খুব সাংঘাতিক। আমাদের কাছে বড়ো ব্যবসায়ীরা ডেইলি ইন্টারেস্টেও টাকা নেয়।
বাবার লোনটা কত দিনের পুরোনো?
বোধহয় সাড়ে তিন বা চার বছর।
তাহলে বাবা আপনাদের জন্যই সুইসাইড করেছে।
অমিত একটু ব্যথিত গলায় বলে, পৃথিবীটা দুর্বলদের জায়গা নয়।
আমার বাবা কিন্তু দুর্বল ছিল না।
তোমার বাবার কথা বলিনি। আমার কথা বলছি।
আপনার কথা! আপনার কথা কেন বলছেন?
কে জানে কেন বলছি। তবে একটা কারণ বোধহয় এই যে, আমি এ ব্যাপারে কিছু করতে পারি না। সবটাই আমার হাতের বাইরে।
বুঝতে পারছি। আপনার সত্যিই কিছু করার নেই। শুনুন, একবারটি আমাদের বাড়িতে আসবেন তাড়াতাড়ি একদিন?
কেন বলো তো!
মুখোমুখি একটু কথা বলব।
লাভ হবে কিছু তাতে?
হবে না?
বোধহয় না। আমার বাবা আর কাকাদের চিট ফাণ্ডের সঙ্গে আমি যুক্ত নই। আমি আলাদা চাকরি করি।
আমরা কোনো সুবিধে চাইব না।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি সেরকম মেয়েও নয়। আমিও ওসব সুদ-আসলের কারবারে নেই। সত্যি বলতে কি আমি আজ তোমাদের দেখতে গিয়েছিলাম, কোনো সাহায্যে আসতে পারি কিনা সেটাই কনসিডার করতে। কিন্তু মনে হচ্ছে, তোমাদের জন্য আর কিছুই করার নেই। তবে আমি একবার যাব। ডেট দিতে পারছি না। তবে হুট করে একদিন–
আপনি কি খুব ব্যস্ত মানুষ?
আমি ইরেকশন ইঞ্জিনিয়ার। হিল্লি-দিল্লি করতে হয়।
বিদেশেও যান?
প্রায়ই। আমাদের কাজই বাইরে বাইরে।
কী তৈরি করেন আপনি?
বেশির ভাগই বাঁধ। পাগলা নদীকে বাঁধি, জলাধার তৈরি করি। একবার এক আরব শেখ নিয়ে গিয়েছিল তার সুইমিং পুল তৈরি করতে। তাও করেছি হাসিমুখে।