যখন ফিরল তিথি তখন তার শরীর ভেঙে আসছে ক্লান্তিতে। ট্র্যাক সুট এই শীতেও ভিজে ন্যাতা হয়ে গেছে ঘামে। ঘরে এসে পোশাক পালটে সে ফ্যান চালিয়ে হাওয়ায় বসল কিছুক্ষণ। ট্র্যাক সুটের পকেট থেকে কার্ডের টুকরো দুটো বের করে টেবিলের ওপর রেখে, জুড়ে, নাম আর ঠিকানাটা আর একবার দেখল। তার স্মৃতিশক্তি ফোটোগ্রাফের মতো তীক্ষ্ণ। সবটাই মুখস্থ হয়ে গেছে।
তাদের ফোনটা ডাউন হয়ে আছে বেশ কিছুদিন। অথচ তিথির মনে হচ্ছে লোকটাকে একবার টেলিফোন করা দরকার। পাশের ব্লকে তিথির এক বন্ধু থাকে। ওদের ফোন আছে।
তিথি আবার পোশাক পালটে বেরিয়ে পড়ল।
মিনিট দশেক বাদে টেলিফোনে সে সেই গলাটা শুনতে পেল।
কে বলছেন?
তিথি বলল, আমি বিপ্লব দত্তের ছোটো মেয়ে তিথি। একটা কথা জানতে চাই।
হ্যাঁ, বলুন।
আমার বাবাকে আপনি চিনতেন বোধহয়!
ভালোই চিনতাম। একসময়ে তাঁর সঙ্গে খুব ভাব ছিল।
আপনি এবাড়িটা কিনতে চান কেন?
কিনতে চাই কে বলল?
চান না?
লোকটা একটু চুপ করে থেকে বলল, মানেটা সেরকমই দাঁড়ায় বটে। কিন্তু…
তিথি সামান্য ধৈর্যহারা হয়ে বলে, আপনি কিছু একটা বলতে চাইছেন না! তাই না?
অমিত একটু দোনোমোনো করে বলে, সবটা ঠিক বলবার মতোও নয়। থাকগে।
দেখুন, আমরা বাড়িটা বিক্রি করতে চাইছি না। বিক্রি করতে হচ্ছে বলে আমাদের খুব মন খারাপ। কেউ নেই যে, আমাদের এ ব্যাপারে হেল্প করতে পারে। আপনার যদি কিছু জানা থাকে তাহলে বলে দিন না। প্লিজ!
অমিত গুহ আবার দোনোমোনো করে বলে, বিপ্লববাবু অনেক কষ্ট স্বীকার করে বাড়িটা করেছিলেন। কষ্টটা আমি চোখের সামনে দেখেছি।
আমরা জানি। বাবাকে লোন নিতে হয়েছিল।
আপনি তো বোধহয় সেই ছোট্ট মেয়েটি! আমি যখন আজ বিকেলে আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম তখন তো আপনার সঙ্গেই দেখা হয়েছিল!
হ্যাঁ। আমাকে তুমি করেই বলুন না। আমি কিন্তু খুব ছোট্ট নই।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি খুব ছোট্ট নও মানছি। কিন্তু এই বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে তুমি কী-ই বা করতে পারবে? এসব বেশ জটিল ব্যাপার। তোমার মামা তো চিন্তা করছেনই।
মামা ঠিক আমাদের সেন্টিমেন্ট তো বুঝবে না। এবাড়িটাকে যে আমরা কত ভালোবাসি। মামা শুধু বিপদটা দেখছে। আর বিপদ থেকে আমাদের বাঁচাতে চাইছে।
বিপদ! কীরকম বিপদ তা কি তোমার জানা আছে?
শুনেছি বাবার অনেক লোন আছে, অনেক পেমেন্ট বাকি আছে। এইসব আর কি। অ্যাসেট বলতে শুধু বাড়িটা।
বাড়ির জন্য যেসব লোন নেওয়া হয়েছিল তার হিসেব আছে কি?
আমি অত জানি না।
তোমরা কি দলিলটা খুঁজে পেয়েছ?
না। তবে মা আমাকে খুঁজতে বলেছে।
অমিত গুহ একটু চুপ করে থেকে বলল, খোঁজবার দরকার নেই। কারণ ওটা তোমাদের কাছে নেই।
তবে কার কাছে আছে?
আছে কারো কাছে।
আপনি কেন ফ্র্যাঙ্কলি বলছেন না?
অমিত গুহ একটু দুর্বল গলায় বলল, ওটা আমার কাছে আছে। তবে ওটা কিন্তু আমি চুরি করিনি।
আপনার কাছে কেন?
বিপ্লববাবুই ওটা আমাকে দিয়েছিলেন। মর্টগেজ কাকে বলে জান?
জানি। বাঁধা রাখা তো!
হ্যাঁ। বিপ্লববাবু একসময়ে ওটা আমার কাছে বাঁধা রেখে টাকা নিয়েছিলেন। ঠিক আমার কাছেও নয়। আমার বাবার কাছে।
কত টাকা?
সে অনেক টাকা।
আপনাদের কাছে! তাহলে তো বাড়িটা আপনাদেরই হয়ে গেছে।
ঠিক তা নয়। আমরা তো ক্লেম করিনি।
এম্মা! তাহলে কী হবে?
আমি বলি, তোমার মামা আর কোনো বায়ারকে না-ডাকলেই ভালো হয়।
আপনি মামাকে কিছু বলেননি কেন?
আমার খারাপ লাগছিল। তোমরা বাড়িটাকে এত ভালোবাসো!
ভালো তো বাসিই। কিন্তু বাঁধা থাকলে তো কিছু করার নেই।
শোনো তিথি, এ ব্যাপারটা এখনই কাউকে বলার দরকার নেই। তোমাকে বলে ফেললাম তোমার নার্ভাসনেস দেখে।
আপনি এখন কী করবেন, বলুন তো! আমরা যদি টাকাটা শোধ দিতে না-পারি?
আমাদের কোম্পানি সেটা ঠিক করবে। ইট উইল বি এ করপোরেট ডিসিশন। তোমরা হয়তো একটা নোটিশ পাবে। এটা রিমাইণ্ডার। প্রথম নোটিশটা বিপ্লববাবুকে মাস ছয়েক আগে দেওয়া হয়েছিল।
আমরা তো তা জানি না।
জানবার কথাও নয়। উনি নোটিশের জবাবে সময় চেয়েছিলেন। ওঁকে ছয় মাস সময় দেওয়া হয়েছিল।
কত টাকার লোন বলতে পারেন?
লোনটা বড়ো কথা নয়। ইন্টারেস্টটাই মারাত্মক। যত দেরি হয় তত বাড়ে। লাফিয়ে লাফিয়ে।
অমিত গুহ যেন মজা করছে এমনভাবে বলল। তিথি চারদিকে চেয়ে দেখে নিল একবার। রাকাদের এই ঘরে কেউ নেই। রাকাদের বাড়িতে এমনিতেই লোক কম। রাকা আর তার মা-বাবা। রাকা পাশের ঘরে পড়ছে। তিথি সুতরাং একা। তবু সে একটু চাপা গলায় বলে, আপনি আজ কেন এসেছিলেন বলুন তো! এলেন তবু কিছুই বলে গেলেন না। আমাদের এখন কী ভীষণ অবস্থা!
অমিত গুহ একটু চিন্তিত স্বরে বলে, আমি ঠিক অফিসিয়ালি যাইনি।
তাহলে?
বাড়িটা বিক্রি হবে একরকম একটা গুজব শুনে আমি কন্ট্যাক্ট করি বায়ার হিসেবে। ইচ্ছে ছিল কত দরদাম উঠছে তা আনঅফিসিয়ালি জেনে নেওয়া। আমাদের কোম্পানি যে লোন রিপেমেন্ট ক্লেম করবে সেটার সঙ্গে বাড়ির দামের কত তফাত হচ্ছে সেটা আঁচ করা। কিন্তু এসব অত্যন্ত কমার্শিয়াল ব্যাপার। তোমার বয়স তো বোধহয় বারো-তেরোর বেশি নয়।
চোদ্দো প্লাস। এ যুগে চোদ্দো অনেকটাই বয়স।
তাই দেখছি।
একটা কথা বলবেন? সুদে আসলে কত দাঁড়িয়েছে?
সঠিক হিসেবে কষা হয়নি। সেটা যাই হোক, ইট ইজ এ ভেরি ভেরি বিগ অ্যামাউন্ট।