সোমনাথ সামনের ঘরে সোফায় একটু কেতরে শুয়ে চোখ বুজে আছে। বোধহয় ভাতঘুম।
মিলি ধীরে ধীরে নীচে নেমে এল। তিথি তার বাবার চেয়ারে বসে একখানা বই পড়ছে। ছুটির দুপুরে তিথি ঘুমোয় না।
কী করছিস?
মা! এসো। তোমাকে এরকম ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন?
আমাদের বাড়ির দলিলটা কোথায় জানিস?
না তো! তোমার কাছে নেই?
না। তোর বাবা আমাকে যেটা দিয়েছিল তা সার্টিফায়েড কপি।
তাহলে ওরিজিন্যালটা কোথায়?
জানি না। এঘরে আছে কিনা খুঁজে দেখবি একটু? ডেসকে বা বুক কেসে?
দেখব মা। জমি আর বাড়ির কি দুটো আলাদা দলিল?
আমি অত জানি না। আমাকে একটা ফাইল দিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল। আমি কি ওসব কচকচি বুঝি? যতদূর মনে হয়, দুটো দলিল। তোর বাবা বলেছিল, ওগুলো ওরিজিন্যাল নয়, তবে অ্যাজ গুড অ্যাজ ওরিজিন্যাল।
একটা লোক এসেছিল একটু আগে।
দেখা হয়েছে?
অমিত গুহ তার নাম। আমার সঙ্গে হয়নি। সোমনাথের সঙ্গে কথা বলে গেছে। সেই ছেলেটাই দলিলের খোঁজ করছিল। সে নাকি তোর বাবাকে চিনত। এবাড়ি তৈরির সময় নাকি ছেলেটা সুপারভাইজ করত।
তিথি চুপ করে রইল। তার গম্ভীর মুখটার দিকে চেয়ে রইল মিলি। এ মেয়েটা তার আরও পর। তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে তিথির সঙ্গেই তার সম্পর্ক সবচেয়ে আলগা, সবচেয়ে দূরত্বের। তিথি কখনো দুর্ব্যবহার করে না তার সঙ্গে, কথা শোনে এবং ভদ্র ব্যবহারও করে। কিন্তু কোনো উত্তাপ নেই। যেন পাশের বাড়ির মেয়ে। বিপ্লব দত্ত মারা যাওয়ার পর সন্তানদের মধ্যে এই অনাত্মীয়তা বড্ড বেশি টের পায় মিলি। অথচ উলটোটাই তো হওয়ার কথা! বাবা মারা গেলে সন্তানেরা কি আরও আঁকড়ে ধরে না মাকে?
মিলির একটু কথা কইতে ইচ্ছে করছিল তিথির সঙ্গে। কিন্তু লাভ কী? অতিশয় ভদ্র গলায় এবং শান্তভাবে তিথি তার প্রশ্নের জবাব দেবে, যতটুকু বলার ততটুকু বলবে, কিন্তু কখনো কোনো আবেগ দেখাবে না।
মিলি তাই ভাবতে ভাবতে ফিরল। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে সে কেবল তার ছেলে-মেয়ের কথাই ভাবে। বুক্কা ছিল নেই-আঁকড়ে, মায়ের কোল-ঘেঁসা। বাবা চলে যাওয়ার পর সে যেন রাতারাতি সাবালক হল। সঞ্চারি আগে মিলির সঙ্গে বসে সাতকাহন বকত। কলেজের কথা, বান্ধবীদের কথা। আজকাল সে কেন মুখে কলুপ এঁটেছে?
সোমনাথ পোশাক পরে তৈরি। মিলিকে দেখে বলে, আজ চলি রে ছোড়দি। দলিল-টলিল একটু খুঁজে রাখিস।
মিলি কিছু বলল না। সোমনাথ চলে গেলে সে সেন্টার টেবিলে পড়ে থাকা ভিজিটিং কার্ডটা তুলে দেখল। কী হবে আর এ কার্ডটা দিয়ে? আনমনা মিলি কার্ডটা দু-ভাগে ছিঁড়ল। চার ভাগে অবশ্য চেষ্টা করেও ছেঁড়া গেল না। শক্ত জাতের কার্ড। আর মিলিও দুর্বল। ফেলে দিল টেবিলের ওপরেই।
.
০৬.
তিথির চুয়িংগাম থাকে ফ্রিজে। ঠাণ্ডা চুয়িংগাম মুখে নিয়ে দাঁতে পিষতে পিষতে সে বিকেলে দৌড়োয়।
চারটে বেজে গেছে। তিথি তার ট্র্যাক সুট আর দৌড়ের জুতো পরে নিয়ে তর তর করে লঘু পায়ে উঠে এল দোতলায়। ফ্রিজ খুলে চুয়িংগাম বের করে সে মোড়ক খুলল। তিথি খুব ডিসিপ্লিন মানে। কখনো যেখানে-সেখানে জিনিস ফেলে না। রান্নাঘরের দরজায় ট্র্যাশবিন রাখা আছে। সেখানে মোড়কের কাগজটা ফেলে সে বেরোনোর সময় দেখতে পেল সেন্টার টেবিলে ছেঁড়া দোমড়ানো কার্ডটা পড়ে আছে। বিরক্তিতে ভ্রূ কোঁচকাল তার। এবাড়ির সকলেই একটু অসতর্ক। সে টুকরো দুটো তুলে ট্র্যাশবিনে ফেলতে গিয়েও ফেলল না। অমিত গুহ। টিকটিক! অমিত গুহ! টিকটিক। কিছু একটা মনে পড়ছে। এ লোকটার পরিচয় ছিল বাবার সঙ্গে। এমনও তো হতে পারে…
ট্র্যাক স্যুটের পকেটে টুকরো দুটো ভরে নিয়ে তিথি লঘু পায়ে বেরিয়ে পড়ে।
খোলা আকাশের নীচে চওড়া পথ ধরে ছুটতে কী যে ভালো লাগে তিথির তা বলার নয়। আর দৌড়। দৌড়ের মতো এমন মন-ভোলানো ব্যাপার আর কিছুই নেই তার কাছে। যখন সে দৌড়োয় তখন বিভোর হয়ে যায়। তার শরীরে গতির জোয়ার বয়ে যেতে থাকে। এক শিহরিত আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে সর্বাঙ্গে। হরেক অ্যাথলেটিকস মিট-এ হাত ভরে প্রাইজ পায় তিথি। দোতলায় একখানা ঘর তার প্রাইজে বোঝাই। কিন্তু প্রাইজটা তার কাছে বড়ো জিনিস নয়, ফার্স্ট সেকেণ্ড হওয়াও নয়। দৌড়ের মধ্যে যে আনন্দ সে পায় তার তুলনায় প্রাইজ আর কতটুকু?
বিপ্লব দত্ত প্রায়ই বলত, আগের জন্মে তুই বোধহয় হরিণ ছিলি। এত ভালো দৌড়োস কী করে? যখন দৌড়োস তখন ঠিক মনে হয় একটা হরিণ ছুটছে।
এইসব রাস্তায় একসময়ে তার বাবার সঙ্গে দৌড়োত তিথি। বিপ্লব দত্ত অবশ্য এত জোরে দৌড়োত না। বয়স, সামান্য মেদজনিত মন্থরতা ছিল। তবু মেয়ের সঙ্গে খানিকটা দৌড়োতে রোজই যেত বাবা। পরনে সাদা শর্টস, গায়ে সাদা টি শার্ট, পায়ে দৌড়ের মোটা সোলের নরম জুতো। আজও তিথির মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা বুঝি একটু পিছনেই আসছে।
সল্টলেক-এ এখনও বেশ কিছু ফাঁকা জমি। পক্ষীনিবাস, পার্ক, গাছপালা, সবুজ মাঠ, বিশুদ্ধ কুয়াশা, তারা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল এখানে। এ জায়গা ছেড়ে কোথাও যে কখনো চলে যেতে হবে তা তো ভাবেনি। এখন কোথায় যাবে তারা? কোন গলিঘুজির মধ্যে, খুপরি খুপরি ঘরে?
বেলা ডুবে যাচ্ছে দ্রুত। তিথি যেন তার শেষ দৌড় দৌড়োচ্ছে। লম্বা লম্বা পায়ে, জোরালো পদক্ষেপে। ঘন শ্বাস, পেশিতে পেশিতে টানটান ব্যথা। তবু দৌড়োয় তিথি। যতদূর যাওয়ার কথা নয় তত দূর দূর চলে যেতে থাকে। যেন আর ফিরে যাওয়া নেই।