–হ্যাঁ, জানি। আমরা জামাইবাবুকে সেজন্য বেশ বকাবকিও করেছি।
আপনারা হয়তো এটাও জানেন যে, উনি ফিলম প্রোডাকশনেও কিছু টাকা ঢেলেছিলেন। সেটাও জলে গিয়েছিল।
সোমনাথ অবাক হয়ে বলে, না তো, এটা জানতাম না।
আমাকে উনি সবই বলতেন। দুঃখের কথা বলার মতো একজোড়া ধৈর্যশীল কান তো আজকাল পাওয়া যায় না। সিমপ্যাথি দেখানোরও দরকার নেই, শুধু শুনলেই মানুষ খুশি হয়, হালকা হয়। আমি শুনতাম। এই বাড়ি তখন তৈরি হচ্ছে। উত্তর দিকে মালপত্র রাখার একটা শেড ছিল। সেখানে একটা বেঞ্চে বসে উনি অনেক কথা বলে যেতেন। হয়তো সেসব কথা ফ্যামিলিতে বলার অসুবিধে ছিল বা বললেও তা শোনার মতো ধৈর্য কারও ছিল না।
সোমনাথ বিরক্ত হয়ে বলল, তা কেন? ফ্যামিলির কাছে উনি যথেষ্ট ফ্র্যাঙ্ক ছিলেন বলেই তো জানি। কিন্তু এসব কথা এখন আর বলেই বা লাভ কী?
অমিত মাথা নেড়ে বলল, না, লাভ নেই। বরং ক্ষতি। আমি শুধু বলতে চাইছি সে-সময়ে এরকম একখানা বাড়ি তৈরি করার মতো টাকা ওঁর হাতে ছিল না।
সেটাও কিন্তু আমাদের অজানা নয়। জামাইবাবু ধার করেছিলেন। কিছু ধার এখনও রয়ে গেছে। বিক্রি করে সেগুলো আমরা শোধ দেব।
কেমন যেন একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে অমিত বলল, বিক্রি করবেন।
সোমনাথ অবাক হয়ে বলে, হ্যাঁ, বিক্রি করব বলেই তো আপনি এসেছেন।
অমিত কেমন যেন অসহায় চোখে চেয়ে থেকে বলল, তা জানি। কিন্তু আপনারা আরও একটু ভাবুন।
কী ভাবব? ভাববার কী আছে বলুন তো! এত বড়ো বাড়ির ট্যাক্স, মেনটেনেন্স, লোন এত সব মিট আপ করা তো সহজ কথা নয়। জামাইবাবু তো কেটে পড়লেন লাইক এ কাওয়ার্ড। পড়ে রইল শুধু লায়াবিলিটিজ।
খুবই নরম গলায় অমিত বলে, কাওয়ার্ড আমরা সবাই।
চা শেষ করে অমিত তার পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে সেন্টার টেবিলে রেখে বলে, যা দাম উঠেছে তা আমার পক্ষে বড্ড হাই। তবে যদি কোনো কারণে বায়াররা না-নেয় তাহলে আমাকে একটা খবর দিলে খুশি হব।
আপনি তো কোনো দর দিলেন না!
অমিত যেন খুব লজ্জা পেয়ে বলল, সেটা বলতেও লজ্জা পাচ্ছি। পরে দেখা যাবেখন।
অমিত গুহ হঠাৎ উঠে পড়ল। সামান্য ভদ্রতাসূচক কী একটু অস্ফুট গলায় বলে বেরিয়ে গেল।
মিলি শুয়েছিল, উঠে এল এঘরে। বলল, কে রে লোকটা?
পাগল! পাগল! জামাইবাবুর চেনা, এবাড়ি কনস্ট্রাকশনের সময়ে সুপারভাইজ করত। তুই দেখেছিস কখনো? নাম অমিত গুহ।
মিলি মাথা নেড়ে বলে, কনস্ট্রাকশনের সময় আমি মাত্র তিন-চারবার এসে দেখে গেছি। ও নামের কাউকে মনে নেই। ও কি বিপ্লবের বন্ধু?
না। বয়সের তো অনেক তফাত, বন্ধু হয় কী করে? তবে ভাব ছিল, ওকে নাকি দুঃখের কথাটথা বলত। আচ্ছা, তুই কি জানিস জামাইবাবু কখনো ফিলম করতে গিয়ে টাকা নষ্ট করেছিল?
মিলি গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলে, না। আমাকে ও কোনও কথা বলত নাকি? কোনো ব্যাপারে কোনো পরামর্শও নিত না। নিজে যা ভালো বুঝত করত। আমাদের জীবনটা ওই কারণেই তো বিষ হয়ে গেল। কত টাকা নষ্ট করেছে বলল?
চিন্তিতভাবে সোমনাথ বলে, অ্যামাউন্ট বলেনি। তবে ফিলম ইজ এ বিগ বিজনেস। টাকাটা কম হবে না।
আর কী বলছিল?
ওরিজিন্যাল দলিল আছে কিনা জিজ্ঞেস করছিল। আছে তোর কাছে?
না। শুধু সার্টিফায়েড কপি।
দলিলটা তাহলে কোথায়?
যতদূর জানি ওরিজিন্যালটা এখনও আমাদের হাতে আসেনি। ও যেন ওরকমই বলেছিল।
কিন্তু এ ছোকরা তো বলে গেল দলিল আছে, অনেক আগেই জামাইবাবু বের করেছে। তাহলে দলিল গেল কোথায়? জামাইবাবুর ঘরে নেই তো?
দাঁতে ঠোঁট চেপে অভিমানে কান্নায় রাঙা হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল মিলি। আজ কতখানি অপমানিত সে, কতখানি অসহায়। একজন মানুষের সঙ্গে এতদিন ঘর করে, তার ছেলে-মেয়ে গর্ভে ধারণ করে, একই ছাদের তলায় বসবাস করেও লোকটার প্রায় কিছুই সে জানে না। লোকটা তাকে জানায়নি। মিলি সহজে কাঁদে না। আজও কান্নার ভঙ্গুর সীমানায় দাঁড়িয়ে টলমল করতে লাগল। ভেঙে পড়ল না শেষ অবধি।
সোমনাথ টয়লেটে গিয়েছিল। ফিরে এসে সোফায় বসে বলল, খুঁজে দেখিস তো। সল্টলেক-এর জমির ভেণ্ডার হচ্ছে সরকার। দলিল নিয়ে কোনো গণ্ডগোল থাকার কথাই নয়।
ছেলেটা আর কী বলল?
সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, আর ওই পুরোনো কথাটথা বলছিল আর কী। ফ্যামিলিতে জামাইবাবু মনের মানুষ পায়নি, দুঃখের কথা শোনার কেউ ছিল না, এইসব আর কী।
বাড়ি কিনতে এসে ওসব কথা কেন?
কে জানে কেন। তবে মনে হচ্ছিল, আরও কিছু বলতে চায়। সেটা শেষ অবধি চেপে গেল। টাকা-ফাকা বিশেষ নেই ছোকরার। শুধু আম্বা আছে। দর শুনে ভয় পেয়েছে মনে হল।
মিলি ভাবছিল অন্য কথা। ওই ছেলেটার কাছে বিপ্লব দত্ত আর কী বলেছে? আর কোন গোপন কথা জানে ওই অমিত গুহ? একজন স্ত্রীর পক্ষে এটা কতখানি অপমানের তা যদি অন্যে বুঝত!
দ্বিতীয় শোওয়ার ঘরে বড়ো খাটে সঞ্চারি আর বুক্কা ঘুমোচ্ছ। বুক্কা একখানা স্পোর্টস ম্যাগাজিন পড়ছিল বোধ হয়, এলানো হাতে সেটা এখনও ধরা। সঞ্চারির নাইটি হাঁটুর ওপর উঠে গেছে। মিলি ম্যাগাজিন সরিয়ে নিল, নাইটি ঠিক করল, তারপর ওদের ঘুমন্ত মুখগুলি দেখল। এগুলো কোনো জরুরি কাজ নয়। মিলি তার সন্তানদের দিকে চেয়ে ভাবছে, এরা তার কতখানি আপনজন? বিপ্লব দত্তের কিছুটা আর মিলির কিছুটা নিয়ে মিলেমিশে এরা তৈরি। তবু এরা আসলে কার? আপনজন কথাটাই এখন ভাবছে মিলি। সন্দেহ হচ্ছে, বিপ্লব দত্তের মতো এরাও তার ঠিক আপনজন নয়।