হ্যাঁ, ঠিক। প্রোটেক্টার না হোক, আমার একজন সঙ্গী চাই। কাউকে না হলে বাঁচব কী করে?
সুকুমার দেখতে বেশ। তা ছাড়া বড় সরল, সোজা ছেলে! কখনও ওকে খারাপ লাগেনি। আজ অপরাহের আলোয় অফিসঘরে বসে মুখোমুখি ওর দিকে চেয়ে হঠাৎ কী হয়ে গেল। ভাবলামকী হবে এত বাছবিচার করে। নিজেকে নিয়ে আর কত বেঁচে থাকা!
বললাম–শোনো সুকুমার, আমি ডিভোর্স চাই।
চাও? ও লাফিয়ে ওঠে। চাই।
আমার স্বামীও চায়। হয়তো ডিভোর্স পেতে কিছু সময় লাগবে।
তারপর কী করবে অলকা?
তারপর করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে সুকুমার। এক দুরন্ত অধৈর্য অনুভব করে বলি।
–অলকা, যদি আমরা এক্ষুনি বিয়ে করি, তা হলে?
আমি ক্ষণকাল চুপ করে থাকি। বুকের মধ্যে নানা ভয়, দ্বিধা, সংস্কার ছায়া ফেলে যায়।
তারপর বলিকয়েকটা দিন সময় দাও।
–দিলাম। কতদিন বলো তো
–দেখি।
একরকম কথা দেওয়াই হয়ে গেল সুকুমারকে! একটু হয়তো কিন্তু রইল, দ্বিধা রইল, তবু ওটুকু কিছু নয়। সেসব দ্বিধা, ভয় ভেঙে সুকুমার ঠিক সাঁতরে আসবে কাছে।
রাতটা মাসির বাড়িতে গিয়ে কাটালাম। জ্বর এল রাতে। তিনটে দিন বাড়ির বার হওয়া গেল না। অল্প জ্বরেই কত যে ভুল বকলাম ঘোরের মধ্যে!
চারদিনের দিন ফের ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। মাসি আজকাল আর আটকে রাখে না, যেতে চাইলে এককথায় ছেড়ে দেয়। ঢিসে বলগা মেয়েকে সকলেরই ভয়।
দোতলার ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা জানালা হাট করে খুলে বন্ধ বাতাস তাড়াই। ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করি। রবিবার। তাড়া নেই।
চায়ের জল চাপিয়ে এলোচুলের জট ছাড়াতে একটু ব্যালকনিতে দাঁড়াই।
কলিং বেল বাজল। এ সময়ে কেউ আসেনা। একমাত্র সুকুমার আসতে পারে। তার তর সইছে না।
কাঁপা বুক নিয়ে গিয়ে দরজা খুলেও সাপ দেখে পিছিয়ে আসার অবস্থা। চৌকাঠের ওপারে জয়দেব দাঁড়িয়ে।
কিক্ষণ কথা ফোটে না কারও মুখে। জয়দেবের চেহারা রোদে পোড়া, তামাটে, কিছু রোগা হয়েছে। মাথার চুল এত হোট যেন মনে হয় কদিন আগে ন্যাড়া হয়েছে। পরনে ধুতি আর ক্রিমরঙা সুতির শার্ট। কিন্তু ধুতিটা এমনভাবে পরেছে যে মনে হয় পাশের ফ্ল্যাট থেকে এল। বাইরে বেরোবার পোশাক নয়।
চৌকাঠের বাইরে থেকে জয়দেব এক পাও ভিতরে আসার চেষ্টা করল না। দাঁড়িয়ে থেকে বলল তুমি এখানে থাকো সে খবর সদ্য পেয়েছি।
কী চাও?
খুব সাধারণ আলাপচারির গলায় জয়দেব বলল কিছু চাই না অলকা। তোমার কাছে ডিভোর্সে মত দিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলাম, তার কোনও উত্তর দাওনি। তোমার কি মত আছে?
একটু গম্ভীর হয়ে বলি-দরজার বাইরে থেকে অত জোরে ওসব কথা বলছ কেন? ভিতরে এসো।
জয়দেব এল। কোনওদিকে তাকাল না, ঘরের আসবাবপত্র লক্ষ করল না। খুবই কুণ্ঠিত পায়ে এসে একটা চেয়ারে বসে বলল–আমি নীচের তলায় প্রভাসবাবুর বাসায় উঠেছি কাল এসো।
প্রভাসের সঙ্গে জয়দেবের চেনা আছে জানতাম। তাই চমকালাম না। দরজা বন্ধ করে এসে জয়দেবের মুখোমুখি বসে বললাম–আমি খুব তাড়াতাড়ি ডির্ভোস চাই।
জয়দেব মুখখানা করুণ করে বলল–তাড়াতাড়ি চাইলেই তো হয় না। কোর্ট থেকে এ সব কেসে বড় দেরি করে। তাড়াতাড়ি চাইলে আরও আগে জানালে না কেন? কবে কেস ফাইল করা যেত!
আমি মাথা নিচু করে বলি-শোনো, ডিভোর্স পেতে দেরি হোক বা না হোক, আমরা তো একটা এগ্রিমেন্টে আসতে পারি।
কী এগ্রিমেন্ট?
বো, আমরা কাউকে কোনও অবস্থাতেই দাবি করব না। পরস্পরের কোনও ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাব না।
–তার জন্য এগ্রিমেন্ট লাগে না অলকা। জয়দেব বলল–আমরা সেই রকমই আছি। কথার স্বর শুনেই বোঝা যায়, জয়দেবের মন এখন অনেক গম্ভীর হয়েছে। জীবনে কোনও একটা সত্য বস্তুর সন্ধান
পেলে মানুষ এত গভীর থেকে কথা বলতে পারে না। তাই আমি ওর মুখের দিকে কয়েকবার তাকালাম। ও আমাকে দেখছিল না। চোখ তুলে দেওয়ালের মাঝারি উচ্চতায় চেয়েছিল। সেই অবস্থায় চেয়ে থেকেই বলল–তুমি একটি ছেলেকে পছন্দ করো শুনেছি। তাকে বিয়ে করার জন্যই কি এত তাড়া?
সত্যিকারের অবাক হয়ে বলি না তো। আমি কাউকেই পছন্দ করি না।
-সুকুমার না কী যেন নাম, শুনছিলাম। তোমার অফিসের।
-ওঃ। বাস্তবিক আমার সুকুমারের মুখটা এখন মনে পড়ল। বললাম–পছন্দ নয়। তবে ওই একরকম।
–ভাল।
–তুমি ডিভোর্স চাইছ কেন? বিয়ে করবে? বললাম।
ও অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল–বিয়ে আর না। মুক্তি চাইছি, নইলে বড় কষ্ট হয়।
কষ্ট কীসের?
-ওই একটা অধিকারবোধ থাকে তো পুরুষের। সেইটে মাঝে মাঝে চাড়া দেয়। ডিভোর্স হয়ে গেলে একরকম শান্তি।
ও।
-আচ্ছা–বলে জয়দেব কুণ্ঠিত পায়ে উঠল। উকিলের চিঠি দেব। তুমি কি অ্যালিম চাও?
–সেটা কী?
খোরপোষ।
না, না। চমকে উঠে বলি।
আচ্ছা তা হলে
–আচ্ছা। বললাম।
দরজা খুলে জয়দেব চলে গেল।
সিঁড়ি বেয়ে ওর পায়ের শব্দ যখন নামছে তখন আমি ঘরের মধ্যে চুলের জটে আঙুল ডুবিয়ে বসে আছি। কত ভাবনা! সে যেন এক আলো-আঁধারের মধ্যে ডুবে বসে থাকা। উঠলাম না, রাঁধলাম না, খেলাম না। শুধু বসে রইলাম।
হঠাৎ এক ভয়ের আঙুল হৃৎপিণ্ডে টোকা মারল। নড়ে উঠল বুকের বাতাস। সচেতন ভীতগ্রস্ততায় টের পাই–আমি কাউকেই ভালবাসি না। কাউকে নয়। কেবলমাত্র নিজেকে। আমি কোনওদিন কাউকে ভালবাসতে পারব না।
কী করে বেঁচে থাকব আমি?
পৃথিবীতে কত দুর্যোগের বর্ষা নামবে কতবার! কত একা কাটবে দিন! কাউকে ভাল না বেসে আমি থাকব কী করে?