আমি মানি। মধু মল্লিকও মানেন দেখে খুব খুশি হলাম। বললাম-কটেজ বা স্মল স্কেল না থাকলে দেশের প্রাণ নষ্ট হয়ে যায় এ আমি স্বীকার করি। তা ছাড়া এদেশের লক্ষ লক্ষ লোক ওইসব নিয়ে আছে। কৃষিভিত্তিক সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ওটার খুবই দরকার।
–লিখুন না একবার স্মল আর কটেজ নিয়ে। মধু মল্লিক বললেন। কাজ সহজ নয় তবে আমার অফিস থেকে প্রচুর সাহায্য করা হল এ ব্যাপারে! কুটির এবং ছোট ছোট শিল্পের ওপর পত্রিকা চারটে সিরিয়াল পাবে। আমাকে সে জন্য গোটা পশ্চিমবাংলার গাঁয়ে গঞ্জে চলে যেতে হল। সরকারি লোকদের সঙ্গে দেখা করা। সেই সূত্রেই জয়দেবের সঙ্গে দেখা বাঁকুড়ায়। ভারী দুঃখী চেহারার লোক এবং খুবই ভালমানুষ! ডক্টরেট হয়েছেন সম্প্রতি, জানেনও বিস্তর। একখানা নতুন বই লিখেছেন ফোক আর্ট সম্পর্কে। কথায় কথায় বিয়ের কথা উঠতে আমি বলেছিলাম আমার বউ-ছেলে সব পর হয়ে গেছে। সেই ভ্যাকুয়ামটা পূর্ণ করতে এখন আমার অনেক কাজ চাই। নইলে একা হলেই ভূতে পায়।
জয়দেব আমার হাত চেপে ধরে বললেন–আমার কেসও আপনার মতো। আমার ছেলেপুলে নেই, কিন্তু বউ ছিল। প্রায় বিনা কারণে সে আমাকে ছেড়ে গেছে।
যোগাযোগটা খুবই অদ্ভুত। অলকার স্বামীকে যে এত সহজে দুম করে খুঁজে পাব কখনও ভাবিনি। পরিচয় বেরিয়ে পড়তে যখন অলকার খবর দিলাম তখন জয়দেব হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে জিজ্ঞেস করল–ও কি আবার বিয়ে করবে?
না, না।
—ওকে বলবেন, মেয়েদের দুবার বিয়ে হতে নেই। সেটা খুব খারাপ। ও আমাকে ছেড়ে যাওয়ায় আমাদের পরিবারে মস্ত ঝড়ের ধাক্কা গেছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো কখনও সমাজ বা পরিবারের পারসপেকটিভে দাম্পত্য জীবনের কথা ভাবেনা। যদি ভাবত তা হলে অলকা অত সহজে ছেড়ে যেতে পারত না। অপছন্দের স্বামীকেও মানিয়ে নিত। আর এও তো সত্যি যে, আজকের অপছন্দের লোক কালই প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারে, যেমন আজকের প্রিয়জন হয়ে যায় কাল দুচোখের বিষ!
সত্যি কথা। সহ্য করা বা বহন করা আজকের মানুষের ধাতে নেই। অপছন্দের জিনিস তারা খুব তাড়াতাড়ি বাতিল করে দেয়। নতুন জিনিস নিয়ে আসে। আর এইভাবেই তাদের স্বভাব হয়ে উঠেছে পিছল ও বিপজ্জনক।
আমি বললাম-আপনি কি এখনও অলকাকে ভালবাসেন?
কেন একরকম লোভী শিশুর মতো তাকাল জয়দেব। অনেকক্ষণ বাদে মাথা নেড়ে বলল–তাতে কী যায় আসে! ও তো আর আমাকে ভালবাসে না!
আমি চিন্তা করে বললাম–দেখুন, ভালবাসাটা সব সময়েই তো আর হুস করে মাটি খুঁড়ে ফোয়ারার মতো বেরোয় না। ওটা একটা প্র্যাকটিসের ব্যাপার। ভালবাসার চেষ্টা থেকেই ভালবাসা আসে।
–সে হতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই চেষ্টারও অভাব রয়েছে। তিলমাত্র মমতা থাকলে তাকে বাড়িয়ে বিরাট ভালবাসা জন্মাতে পারে। কিন্তু যেখানে সেই তিলমাত্রও নেই?
আমি ভাবিত হয়ে পড়ি। এবং ফিরে আসি।
কলকাতায় এসেই একটু ঝামেলায় পড়ে গেলাম।
একদিন অনেক রাত অবধি টাইপ মেশিন চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছি। ভোররাতে এসে ঘুম ভাঙাল সুহাস।
দরজা খুলে তাকে দেখে খুব খুশি হই না, বললাম–কী রে, কী চাস?
মার খুব অসুখ। এখন-তখন অবস্থা। কী করব।
শরীরে একটা ধনুকের টংকার বেজে উঠল। মা!
কথা আসছিল না মুখে। অবশ হয়ে চেয়েছিলাম, সুহাস বলল–কিছু টাকা দাও।
টাকা দেব? অবাক হয়ে বলি–টাকা দেব সেটা বড় কথা কী। আগে গিয়ে মাকে একটু দেখি! তুই ট্যাক্সি ডাক তো।
বলে আমি ঘরে গিয়ে জামাকাপড় পরছিলাম। সুহাস ট্যাক্সি আনতে যায়নি, দরজার কাছে দোনোমনো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে পড়তে বলল–তুমি বিশ্রাম নাও না! এক্ষুনি যাওয়ার দরকার নেই খুব একটা। অবস্থা যতটা খারাপ হয়েছিল ততটা এখন নয়। তুমি ব্যস্ত মানুষ, দু-চারদিন পরে যেয়ো।
ওর কথা বুঝতে পারছিলাম না একদম। আবোল-তাবোল বকছে? এই বলল খারাপ অবস্থা, আবার বলছে তত খারাপ নয়। কেমন একটু সন্দেহ হল মনে। বললাম-তোর মুখে সত্যি কথাটথা আসে তো ঠিক?
বাঃ, মিথ্যে বলছি নাকি?
আর অসুখ, তা আমাকে যেতে বারণ করছিস কেন?
–তোমার অসুবিধের কথা ভেবেই বলেছি। যাবে তো চলো।
ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আয়, আমি যাব।
দমদমের বাসার কাছে এসে যখন ট্যাক্সির ভাড়া মেটাচ্ছি তখন সুহাস এই একটু আসছি বলে কথায় কেটে পড়ল। বাড়িতে ঢুকে দেখি মা পিছনের বারান্দায় বসে কুলোয় রেশনের চাল বাছছে।
আমি গিয়ে মার কাছে বসতেই মা কুলো ফেলে আমাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে বলল, ওরা বলে তুই নাকি খুব খারাপ হয়ে গেছিস! কোনও এক বিধবা না সধবার সঙ্গে নাকি তোর বিয়ে সব ঠিক?
আমি স্তম্ভিত হয়ে মাকে দেখি। অনেকক্ষণ বাদে বলি-তোমার কী হয়েছে? শুনলাম তোমার খুব অসুখ।
হলে বাঁচি বাবা। সে অসুখ যেন আর ভাল না হয়। কিন্তু গতরে তো অসুখও একটা করে না তেমন।
সুহাস আজ সকালে গিয়ে তোমার অসুখের নাম করে টাকা চেয়েছিল।
মা হাঁ করে একটু চেয়ে থেকে বলে–ওর অবস্থা খুব খারাপ বাবা, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তাই বোধহয় এই ফিকির করেছিল।
রান্নাঘর থেকে নিমি খুব হাসিমুখে এককাপ চা নিয়ে বেরিয়ে এসে বলল-দাদাকে কতদিন বাদে দেখলাম। খুব ব্যস্ত শুনি।
আমি গম্ভীর হয়ে বলি-সুহাস কোথায় গেল বউমা?
এসে পড়বে এক্ষুনি। বসুন না।