আমি খুব সাবধান হয়ে গেছি আজকাল। বাইরের দরজাটায় সব সময় ল্যাচকিতে চাবি দিয়ে রাখি। স্পাই হোল দিয়ে না দেখে আর নাম ধাম জিজ্ঞেস না করে বড় একটা দরজা খুলি না। অবশ্য আমার ঘরে আসবেই বা কে?
একদিন আমার দাদা অভিজিং এল। সে বরাবর রোগা দুর্বল যুবক, শীত গ্রীষ্মে গলায় একটা সুতির কক্ষটার থাকবেই। ঠাণ্ডা জলে স্নান করতে পারে না, সারা বছর তার সর্দি থাকে। ডাক্তার বলেছে এ রোগ সারার নয়।
সকালবেলায় দাদা এসে ঘরে পা দিয়েই ঝগড়া শুরু করল–এ তুই শুরু করেছিস কী বল তোর আমাদের পরিবারটা মডার্ন বটে, কিন্তু তুই যে সব লিমিট ছাড়িয়ে গেলি!
রাগ করে বললাম–ও কথা বলছিস কেন? একা থাকি বলে যত খারাপ সন্দেহ, না?
বটেই তো। জয়দেবের সঙ্গে না থাকিস আমরা তো রয়েছি। এ দেশের সমাজে একা থাকে কোন মেয়ে?
–আমি থাকব।
–না, থাকবি না। তোর ঝাটি-পাটি যা আছে গুছিয়ে নে, আমি ট্যাকসি ডাকি।
নিজের বাড়ির কোনও লোককেই আজকাল আমার সহ্য হয় না। ওরা আমাকে স্বাভাবিক জীবন গ্রহণ করতে শেখায়নি। সেটা আজকাল আমি বড় টের পাই। চারদিকে যখন স্বামী-স্ত্রীর বসবাস দেখি তখনই আমার মনে হয়, আমারই যেন কী একটা ছিল না, হয়তো সইবার শক্তি বহনের ক্ষমতা, যা না থাকলে বিবাহিত জীবন বলে কিছু হয় না।
আমি দাদার জন্য চা করতে গিয়ে মনটাকে শক্ত করলাম খুব।
ফিরে এসে বললাম-জয়দেব বা আর কারও সঙ্গে আমি থাকব না।
–জয়দেবেরই বা দোষটা কী?
যাই হোক। সব কি তোকে বলতে হবে নাকি?
কথায় কথায় ঝগড়া লেগে গেল। দাদা খুব জোরে চেঁচিয়ে কথা বলছিল। এই সময় ফোনটা আবার বাজল। দৌড়ে গিয়ে রিসিভার কানে তুলতেই সেই ধীর গম্ভীর গলায় বলল–আপনার ঘরে লোকটা কে?
আমি ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে বললাম আসুন না প্রভাসবাবু একটু হেলপ করবেন। এ লোকটা আমার দাদা, বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।
টেলিফোনে গলাটা শুনেই আজ আমি লোকটাকে চিনে ফেলেছি। কথা কটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশে হাসি শোনা গেল। প্রভাসরঞ্জন বললেনবড্ড মুশকিল হল দেখছি! চিনে ফেললেন! দাদা কী বলছেন?
–ফিরে যেতে।
–তাই যান না। জয়দেববাবুর তো কোনও দোষ নেই।
–আপনি সেটা জানলেন কী করে?
খোঁজ নিয়েছি। ইনফ্যাক্ট আমি জয়দেববাবুর সঙ্গেও দেখা করেছি কদিন আগে।
–মিথ্যে কথা।
না, মিথ্যে নয়। আমি এখন একটা ডেইলি নিউজ পেপারের স্পেশাল রিপোর্টার। মধু মল্লিক যে কাগজে কাজ করেন।
–তাতে কী?
–সেই কাগজের তরফ থেকে স্মল স্কেল আর কটেজ ইন্ডাস্ট্রির একটা সার্ভে করেছিলাম। জয়দেববাবু ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। খুব পণ্ডিত লোক।
আমার কথা উঠল কী করে?
উঠে পড়ল কথায় কথায়।
দাদা এসে এ ঘরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে ফোনের কথা শুনছে। একবার চোখের ইশারা করে জিজ্ঞেস করল–কে?
আমি হাত তুলে ওকে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করে ফোনে বললাম, আপনিই আমার কথা তুলেছিলেন।
-তাই না হয় হল, ক্ষতি কী?
ক্ষতি অনেক। তার আগে বলুন, আপনার এ ব্যাপারে এত ইন্টারেস্ট কেন?
প্রভাসরঞ্জন কিছু গাঢ় গলায় ইংরিজিতে বললেন–বিকজ আই হ্যাভ অলসোঁ লস্ট সাম অফ মাই হিউম্যান পজেশনস।
ফোন কেটে গেল।
দাদা বলল-কে রে?
একজন চেনা লোক।
দাদা গম্ভীর হয়ে বলল–চেনা লোক! বাঃ, বেশ। চেনার পরিধি এখন পুরুষমহলে বাড়ছে তা হলে।
আমি ছোট্ট করে বললাম–বাড়লে তোর কী?
–আমার অনেক কিছু। সে থাকগে, একি লোকটা তোকে কী বলছিল?
আমি হঠাৎ আক্রোশে রাগে প্রায় ফেটে পড়ে বললাম–তোরা কেউ কি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবি না!
দরজার কাছ থেকে প্রভাসরঞ্জন বললেন শান্তিতে কি এখনই আছেন? যান তো, একটু চা করে এনে খাওয়ান। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম লোকটার সাহস দেখে।
০৯. প্রভাসরঞ্জন
পাঁচুদাকে দেখেই বুঝি যে লোকটার হয়ে গেছে। ব্যাচেলার মানুষ আত্মীয়স্বজন বলতেও কাছের জন কেউ নেই, মরলে কেউ বুক চাপড়াবে না, অনাথা বা অনাথ হবে না কেউ। সেই একটা সান্ত্বনা। তবু একটা মানুষ ছিল, আর থাকবে না এটা আমার সহ্য হচ্ছিল না। বলতে কি পাঁচুদার জন্য বেশ দুঃখিত হয়ে পড়েছিলাম।
ব্যাচেলারদের বেশি বয়েসে কিছু-না-কিছু বাতিক হয়ই। সম্ভবত কামের অচরিতার্থতা, নিঃসঙ্গতা ইত্যাদি মিলেমিশে তাদের বায়ুগ্রস্ত করে তোলে। পাঁচুদারও তা-ই হয়েছিল। চিরকাল তাঁর দূর সম্পর্কের যত আত্মীয়স্বজন তাঁর কাছ থেকে পয়সাকড়ি বা জিনিসপত্র হাতিয়েছে। ভণ্ড সাধু সন্ন্যাসী জ্যোতিষেরাও কাজ গুছিয়েছে কম নয়। পাঁচুদা কয়েকবারই জোচ্চোরদের পাল্লায় পড়ে ব্যবসাতে নেমে ঠকে এসেছেন। তাঁর বাপের কিছু টাকাও তিনি পেয়েছিলেন, চাকরির বেতন তো ছিলই, সব মিলেই বেশ শাঁসালো খদ্দের। লোকে ঠকাবে না কেন? প্রতি বছর মাসখানেক ধরে তীর্থ ভ্রমণ করতেন। ভারতবর্ষের এমন জায়গা নেই যেখানে যাননি। শেষ বয়সটায় বেশ কষ্ট পেলেন।
আমার মধ্যে একটা পাপবোধ ছিল। আমাদের ছেলেবেলায় যখন প্রচণ্ড অভাবের সময় চলছিল তখন এই পাঁচুদা বেশ কয়েকবার আমাদের অনাহার থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকেই তাঁর প্রতি আমাদের একটা মতলববাজ মনোভাব জন্মায়। পাঁচুদা মানেই হচ্ছে আদায়ের জায়গা। তাই পাঁচুদা আমাদের বাড়িতে এলেই আমরা খুশি হতাম, যখন-তখন তাঁর বাসা বা অফিসে গিয়ে নানা কাঁদুনি গেয়ে পয়সা আদায় করেছি। আমার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার ফি তিনিই দেন। আর, আমি তাঁর একটা সোনার বোতাম চুরি করেছিলাম।