লন্ড্রিওয়ালাও মেজাজ দেখাল-হারানো শাড়ির দাম সবাই বাড়িয়ে বলে। ও সব আমাদের জানা আছে। যা নিয়ম আছে সেই অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ নিতে পারেন, শাড়ি পাওয়া যাবে না। যা করবার করতে পারেন, যান।
শেষের ওই যান কথাটাই আমাকে ভীষণ অবাক আর কাহিল করে দিল। লন্ড্রিওয়ালা লোকটার চেহারা ভীষণ লম্বা, কালো, গুণ্ডার মতো, বয়সেও ছোকরা। কয়েকদিন কাচিয়েছি এ দোকানে, খুব একটা খারাপ ব্যবহার করেনি। আজ হঠাৎ মনে হল, এই ইতর লোকটাই বুঝি দুনিয়ার সেরা শয়তান। আমারই বা কী করার আছে? কী অসহায় আমরা! যান বলে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
রাগে, দুঃখে ফেটে পড়ে আমি বললামযান মানে! কেন যাব? আপনি যে কাপড়টা চুরি করে নেননি তার প্রমাণ কী? ওয়াশিং চার্জের দশগুণ ক্ষতিপূরণ দিলেই যদি অমন দামি একখানা কাপড় হাতিয়ে নেওয়া যায়!
লোকটা বুক চিতিয়ে বলল–অ্যাঃ,দামি কাপড়! আমরা ভদ্রলোকের ছেলে, বুঝলেন! দামি জিনিস অনেক দেখেছি, ফালতু পাটি নই।
দোকানের দু-একজন কর্মচারী মালিকের পক্ষে সায় দিয়ে কথা বলছে। খুব অসহায় লাগছিল আমার। এ সময় একজন জোরালো পুরুষ সঙ্গীর বড় দরকার হয় মেয়েদের।
একথা ভাবতে-ভাবতেই হঠাৎ যেন দৈববলে একজন ভদ্রলোক রাস্তা থেকে উঠে এলেন দোকানে। বেশ ভদ্র চেহারা, তবে কিছু রোগাভোগা। চোখেমুখেও বেশ দুঃখী বিনয়ী ভাব।
লোকটা দোকানে ঢুকে কয়েক পলক আমাকে দেখে নিয়ে মাথা নিচু করে বলল-ট্রাবলটা কী?
শোনাবার লোক পেয়ে আমি বেঁচে গেলাম। অবিরল ধারায় কথা বেরিয়ে আসছিল মুখ থেকে।
লোকটা শুনল। কথার মাঝখানে মাথা নাড়ল! দোকানদার বাধা দিয়ে নিজের কথা বলতে চাইছিল, কিন্তু লোকটা তাকে পাত্তা দিল না। সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনেটুনে একটা শ্বাস ফেলে বলল–হু।
লোকটাকে আমার চেনা-চেনা ঠেকছিল প্রথম থেকেই। কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু তখন শাড়ি হারানোর দুঃখ আর লড়িওয়ালার অপমানে মাথাটা গুলিয়ে ছিল বলে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
লোকটা লন্ড্রিওয়ালার দিকে একটু ঝুঁকে খুব আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে কী যেন বলল। লন্ড্রিওয়ালা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, দেখলাম।
আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছি। কিছু শুনতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছিল লোকটা যেন লড্রিওয়ালার বন্ধু, আবার আমারও শুভানুধ্যায়ী।
খানিকক্ষণ ওইসব ফিসফাস কথাবার্তার পর হঠাৎ লন্ড্রিওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে বলল–দিদি, একটা শেষ কথা বলে দেব? আমি একশোটা টাকা দিতে পারি খুব জোর।
আমি ভীষণ অবাক হয়ে যাই। যদিও আমার শাড়িটার দাম অনেক বেশি, তা হলেও সেটা তো অনেকদিন পরেছি। তা ছাড়া ত্রিশ টাকার জায়গায় একশো টাকা শুনে একটা চমক লেগে গেল। তবু বেজার মুখ করে বললাম–তাও অনেক কম। তবু ঠিক আছে।
লড্রিওয়ালা টাকা নিয়ে কোনও গোলমাল করল না, সঙ্গে সঙ্গে একটা ড্রয়ার টেনে টাকা বের করে দিল। রসিদ সই করে দিলে লন্ড্রিওয়ালা লোকটিকে বলল-প্রভাসবাবু, আপনিও সাক্ষী হিসেবে একটা সই করে দিন।
লোকটা সই করলে আমি নামটা দেখলাম। প্রভাসরঞ্জন। কোনও পদবি লিখল না।
বেরিয়ে আসার সময় প্রভাসরঞ্জনও এল সঙ্গে সঙ্গে। রাস্তায় কাঠফাটা রোদ। এই সকালের দিকেই সারা দিনের অসহনীয় গরমের আন্দাজ দিচ্ছে। আমি ব্যাগ থেকে সানগ্লাস বের করে পরে নিলাম। এখন অফিস যাব, তাই ট্রাম রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার আগে প্রভাসবাবুকে বললাম আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি না এলে লোকটা টাকাটা দিত না।
প্রভাসবাবু মৃদু হেসে বললেন–আপনি কি টাকাটা পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন?
আমার ভ্রু কুঁচকে গেল। প্রশ্নটার মধ্যে একটু যেন খোঁচা আছে। বললাম না। কেন বলুন তো!
–একটা শাড়ির সঙ্গে কত কী স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। শাড়ির দামটা তো বড় নয়।
আমি মৃদু হেসে বললাম–তাই। তা ছাড়া শাড়িটাও বড় ভাল ছিল।
প্রভাস মাথা নেড়ে বলেন-বুঝেছি। ও টাকা দিয়ে আর একটা ওরকম শাড়ি কিনবেন?
–কিনতে পারি। কিন্তু একরকম শাড়ি তো আর পাওয়া যায় না। দেখা যাক।
প্রভাসরঞ্জন আমার সঙ্গে ট্রাম রাস্তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন–শাড়িটা আপনাকে কে দিয়েছিল?
এবার আমি একটু বিরক্ত হই। গায়েপড়া লোক আমার দুচোখের বিষ। বললাম–ওটা আমার খুব পারসোনাল ব্যাপার।
প্রভাসরঞ্জন আমার দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে বললেন–আমি অবশ্য আন্দাজ করতে পারি।
করেছিস না হয় একটু উপকার, তা বলে পিছু নেওয়ার কী? পুরুষগুলো এমন বোকা হয়, কী বলব! তবু ভদ্রতা তো আর আমাদের ছাড়ে না। আমার আবার ওই এক দোষ, সকলের সঙ্গে প্রত্যয়ের একটু সুরে কথা বলে ফেলি। তা ছাড়া, লোকটার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওর আন্দাজটা সত্যিই হতে পারে।
বললাম কী আন্দাজ করলেন?
প্রভাসরঞ্জন মৃদু স্বরে বললেন–আপনার স্বামী।
আমি একটু কেঁপে উঠলাম মনে মনে। কপালে বা সিথিতে আমি সিঁদুর দিই না। সম্পূর্ণ কুমারীর চেহারা আমার। তা ছাড়া যে এলাকায় আছি সেখানকার কেউ আমাকে চেনে না। এই লোকটা জানল কী করে যে আমার একজন স্বামী আছে?
এবার একটু কঠিন স্বরে কথা বলাটা একান্ত দরকার। লোকটা বড় বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।
বললাম–আমার স্বামীর খবর আপনাকে কে দিল? আমার স্বামী-টামী কেউ নেই।
লোকটা অবাক হয়ে বলে–নেই! তা হলে তো আমার আন্দাজ ভুল হয়ে গেছে!