কিন্তু কে কার কথা শোনে!সুহাস আর তার বউ ঝগড়ার চোটে প্রায় নাচতে লাগল। সুহাস তড়পায়, পেছন থেকে নিমি তাকে সাহস দেয়। শক্তিদায়িনী নারী কাকে বলে জানলাম। দুজনেই দিগ্বিদিকশূন্য, কাপড়চোপড় গা থেকে খসে পড়ছে প্রায়।
এ বাড়ি ভাগ করা যে আমার কর্ম নয় তা বুঝলাম। ভীমরুল চাক বেঁধেছে, ঢিল মারলে রক্ষে নেই। বাবাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললাম–দেখছেন তো ওদের অ্যাটিচুড। বাড়ি ভাগ কী করে হবে?
বাবা অসহায়ভাবে বললেন তুমি আলাদা বাসা করো।
সেই পুরনো কথা। বিরক্ত হয়ে বলি–সেটা সম্ভব নয়। আলাদা বাসা করলেও আমি আপনাদের সঙ্গে থাকব না। আমার একা থাকা দরকার।
বাবা চুপ করে রইলেন। অনেকক্ষণ বাদে বললেন বাবা প্রভাস, আমি সারা জীবন কখনও সুখে থাকিনি। গত জষের দোষ ছিল বোধহয়। তা এখন কী করতে বলল আমাকে? গলায় দড়ি দেব?
আমি কিছু লজ্জা পেয়ে চুপ করে থাকি।
বাবা বললেন তুমি বিদেশ থেকে ফিরে এসেছ দেখে বড় আশায় বুক বেঁধেছিলাম। বিশ্বাস ছিল, তুমি আমাকে ফেলবে না। কিন্তু এখন
আমি বললাম তার চেয়ে কোনও বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে
বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম–কোনও আশ্রম-টাশ্রমে যদি বন্দোবস্ত হয়, তা হলে?
বাবা মাথা নাড়লেন। চোখে বুঝি জল এসেছিল, সেটা মুছে নিয়ে বললেন-বুঝেছি। আপত্তি কী? তাই না হয় দেবো।
বাবাকে ভরসা দিয়ে বললাম-টাকা যা লাগে আমি কষ্ট করে হলেও দেবখন।
–সে জানি। দিয়ে। তোমরা না দিলে গতি কী?
যোগাযোগ করে নানা মুরুব্বি ধরে বাবার জন্য কাশীতে একটা বন্দোবস্ত হল। মাসখানেক আগে বাবা একখানা রেঙ্গ আর শতরঞ্জিতে বাঁধা বিছানা নিয়ে ট্রেনে চাপলেন।
মার জন্য খুব চিন্তা নেই। মা যেন কীভাবে এই সংসার প্রোথিত বৃক্ষের মতো রয়েই গেল। সাধারণত শাশুড়ির সঙ্গে বউদের অবনি দেখা যায়। আমাদের বাড়িতে উল্টো নিয়ম দেখি। তার মানে এই নয় যে নিমিতে আর মাতে ঝগড়া হয়না। বরং খুবই হয়। কিন্তু সুহাসের বুঝি মায়ের প্রতি একটু টান আছে। বাড়িতে ঢুকেই কিট একটা মা ডাক দেয় রোজ। আর একটা ব্যাপার হল, এ সংসারে হাজারো কাজে মা জান বেটে দেয়। বিনি মাগনা কেবল খোরাকি দিয়ে এমন বিশ্বস্ত ঝি-ই-বা নিমি কোথায় পাবে? তাই ঝগড়াটি হলে, মাকে ফেলতে চায় না। মায়েরও আবার সুহাসের ওপর টান বেশি। এ সব টানের। কোনও ব্যাখ্যা হয় না। সবচেয়ে অপদার্থ ছেলেটাকেই মা কেন ভালবাসে তা বিশ্লেষণ করা বৃথা।
বাড়ির এই পরিস্থিতিতে যখন আমি বাড়ি ছাড়ব-ছাড়ব ভাবছি, সেই সময়ে মুমূর্ষ পাঁচুদা একদিন আমাকে বললেন–তোর যখন বনছে না তখন আমার বাসাটায় গিয়ে থাক না কদিন। তালাবন্ধ পড়ে আছে।
বাঁচলাম হাঁফ ছেড়ে। শোনার পর অপেক্ষা করিনি। সে রাতটা ভাল করে ভোর হওয়ার আগেই পাঁচুদার পার্ক সার্কাসের ফ্ল্যাটে এসে উঠেছি।
ব্যাচেলার মানুষ পাঁচুদা। ঘরে রান্নাবান্নার সব বন্দোবস্ত রয়েছে। আসবাবপত্রও কিছু কম নেই। সারাজীবন নিজের শখ শৌখিনতার পিছনে অজস্র টাকাপয়সা ঢেলে গেছেন। টাকাপয়সা জমাননি বড় একটা। ঠকবাজেরাও লুটেপুটে নিয়েছে। ফ্ল্যাটে এসে শুনলাম ছমাসের ভাড়া বাকি পড়ে আছে। অথচ বাথরুমে গিজার, ঘরের মেঝেয় কার্পেট, রান্নাঘরে মিনি রেফ্রিজারেটার কী নেই?
হাসপাতালে দেখা করতে গেলে পাঁচুদা বললেন–যদি আমি বেঁচে যাই তো আলাদা কথা, নইলে ওই ফ্ল্যাট তোকেই দিয়ে গেলাম। সব জিনিসপত্ৰসুন্ধু।
আমি বললাম–অত কিছু বলার দরকার নেই পাঁচুদা। আপনি মরছেন না শিগগির। আপাতত কিছুদিন থাকার জায়গা পেলেই আমার যথেষ্ট।
বাড়িওলাকে ছমাসের ভাড়া আমাকে শোধ করতে হল। লোকটা গণ্ডগোল শুরু করেছিল। টাকাপয়সা খরচ হল বটে, কিন্তু মোটামুটি একটা থাকার জায়গা পেয়ে বড় খুশি লাগল। দমদমের নরক থেকে তো দূরে আছি।
জ্যোতিষ নরেনবাবু কিন্তু মাস দুয়েক আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, মাসখানেকের মধ্যে বাসস্থানের পরিবর্তন।
লোকটার ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে যায়।
সারাদিন প্রায়ই কাজ থাকে না। রান্নাবান্না করি, খাই। দুপুরে একটু ঘুম। বিকেলের দিকে নরেনবাবু কিংবা পাঁচুদার ওখানে যাই। বন্ধুবান্ধব কেউ নেই। নিরালা, নির্জন সময় কাটে। বেঁচে থাকার অর্থ নেই।
এ বাড়ির দোতলা থেকে প্রায়ই একটা মেয়েকে নামতে উঠতে দেখি। চেহারাটা বেশ। বিয়ের বয়স হয়েছে তো বটেই, একটু বেশিই হয়েছে বুঝি। মাথায় সিঁদুর দেখি না। খুব সাজগোজ করে অফিসে যায়। তার বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনও কেউ আসে না বড় একটা। মেয়েটা আমার মতোই একা কি?
ভেবে ভেবে একটু কেমন হয়ে গেল মনটা, দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে আমার মেয়েদের সম্পর্কে বাঙালিসুলভ লজ্জা-সঙ্কোচ হয় না। আবার কাউকে দুদিন দেখলেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো দুর্বলতাও নেই আমার। বরং মেয়েদের ব্যাপারে আমি এখন অতিশয় হিসেবি।
নীচের তলায় পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক বড় একটা ইংরেজি কাগজের রিপোর্টার। অল্প ক দিনেই আমার সঙ্গে বেশ খাতির হয়ে গেছে। তাঁর বউকে বউদি বলে ডাকি। মাঝেমধ্যে মাংস বা মাছ পাঠিয়ে দেন, কফি করে ডেকে নিয়ে খাওয়ান। দুজনেরই বয়স চল্লিশের ওপরে। রিপোর্টার ভদ্রলোকের নাম মধু মল্লিক। নিজের কাজে তাঁর বেশ সুনাম আছে। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান অনেকবার ঘুরে এসেছেন। নিজের কাজকে প্রাণাধিক ভালবাসেন। আর সেই কারণেই তাঁকে অনবরত বাইরে ঘুরে বেড়াতে হয়। গত কয়েক মাসে দেখলাম, মধু মল্লিক একবার দিল্লি বম্বে, একবার অরুণাচল প্রদেশ একবার ওড়িশা ঘুরে এলেন। তা ছাড়া দিনরাত অফিসের গাড়িতে শহর চক্কর মারা তো আছেই। বলেন–ভাই, এই চাকরি করতে করতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে দুদিন ঘরে থাকতে হলে হাঁপিয়ে পড়ি। তাই ভয় হয়, রিটায়ার করলে এক হপ্তাও বাঁচব না।