জয়ন্ত ছবিটার দিকে চেয়ে থেকেই বলে, আপনার টুপু সুন্দরী।
আমার হতে যাবে কেন?
দেখি আপনার হাতটা আর একটু।– বলে জয়ন্ত হাত বাড়িয়ে ধৃতির ডান হাতটা টেনে নিলেন।
ফোটোগ্রাফার সৌরীন এক প্লেট মাস আর চার পিস রুটি খেয়ে মৌরি চিবোতে চিবোতে টেবিলের ধারে এসে বলে, আমার হাতটা দেখবেন না জয়ন্তদা?
পরে।– জয়ন্তর গম্ভীর উত্তর।
অনেকদিন ধরে ঝোলাচ্ছেন। ধৃতিবাবু, কী খবর?
ভাল।
সৌরীন হঠাৎ বুকে ছবিটা দেখে বলে, বাঃ, দারুণ ছবিটা তুলেছে তো! ফোটোগ্রাফার কে?
ধৃতি হাসল। সৌরীন পেশাদার ফোটোগ্রাফার, তাই মেয়েটার চেয়ে ফোটোর সৌন্দর্যই তার কাছে বেশি গুরুতর।
ধৃতি বলে, মেয়েটা কেমন?
ভাল।– সৌরীন বলে, তবে ফ্রন্ট ফেস যতটা ভাল প্রোফাইল ততটা ভাল কি না কে জানে। মেয়েটা কে?
চিনবেন না। ধৃতি বলল।
সৌরীন চলে গেলে জয়ন্ত ধৃতির হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, হু।
হু মানে?
মানে অনেক ব্যাপার আছে। আপনার বয়স এখন কত?
উনত্রিশ বোধহয়। কম বেশি হতে পারে।
একটা ট্রানজিশন আসছে।
কী রকম?
তা হুট করে বলি কেমন করে?
কবে?
শিগগিরই।
ধৃতি অবশ্য এসব কথার গুরুত্ব দেয় না। সারা জীবনে সেকখনও ভাগ্যের সাহায্য পেয়েছে বলে মনে পড়ে না। যা কিছু হয়েছে বা করেছে সে, তা সবই নিজের চেষ্টায়, পরিশ্রমে।
ধৃতি বলল, খারাপ নয় তো?
হয়তো খারাপ। হয়তো ভাল।
ধৃতি হাসল। বলল, এবার আসুন ডিম খাই। আমি খাওয়াচ্ছি।
দুজনে ওমলেট খেতে লাগল। খেতে খেতে ধৃতি বলে, জয়ন্তদা, আপনি টুপুর কেসটা যত সিরিয়াসলি দেখছেন ততটা কিছু নয়।
তাই নাকি?- নিস্পৃহ জবাব জয়ন্তর।
ওর মা চাইছে খবরটা কাগজে বেরোক।
খবরদার বের করবেন না।
আরে মশাই, আমি ইচ্ছে করলেই কি বের করতে পারব নাকি? কাগজ তো আমার ইচ্ছেয় হাবিজাবি খবর ছাপাবে না।
তা হলেও আপনি কোনও ইনিশিয়েটিভ নেবেন না। মেয়েটার মা ফোনে আপনাকে কী বলেছিল?
এলাহাবাদ থেকে ট্রাককল করেছিল। রাত তখন দুটোআড়াইটে। শুধু বলছিল টুপুকে খুন করা হয়েছে, আপনি খবরটা ছাপবেন।
চিঠিটা কবে এল?
আজ।
দেখি।– বলে জয়ন্ত হাত বাড়িয়ে খামটা নিলেন।
আবার অনেকক্ষণ চুপচাপ। তারপর চিঠি ফেরত দিয়ে জয়ন্ত হেসে বললেন, আপনি মশাই দিনকানা তোক।
কেন?
চিঠিটা ভাল করে দেখেছেন? দে
খেছি তো।
কিছুই দেখেননি। চিঠির ওপর এলাহাবাদের ডেটলাইন। কিন্তু খামের ওপর কলকাতা উনত্রিশ ডাকঘরের শিলমোহর, সেটা লক্ষ করেছেন?
ধৃতি একটা চমক খেয়ে তাড়াতাড়ি খামটা দেখে। খুবই স্পষ্ট ছাপ। ভুল নেই।
ধৃতি বলে, তাই তো!
জয়ন্ত বলেন, এবার টেলিফোনটার কথা বলুন তো।
সেটা এলাহাবাদের ট্রাকলই ছিল।
কী করে বুঝলেন?
অপারেটার বলল যে।
অপারেটারের গলা আপনি চেনেন?
না।
তবে?
তবে কী?
অপারেটার সেজে যে-কেউ ফোনে বলতে পারে এলাহাবাদ থেকে ট্রাঙ্ককলে আপনাকে ডাকা হচ্ছে। অফিসের অপারেটারও সেটা ধরতে পারবে না।
সেটা ঠিক।
আমার সন্দেহ সেই ফোন কলটা কলকাতা থেকেই এসেছিল।
ধৃতি হঠাৎ হেসে উঠে বলে, কেউ প্র্যাকটিক্যাল জোক করেছিল বলছেন?
জোক কি না জানি না, তবে প্র্যাকটিক্যাল অ্যান্ড এফেকটিভ। আপনি তো ভোঁতা মানুষ নন, তবে মিসলেড হলেন কী করে? এবার থেকে একটু চোখ কান খোলা রেখে চলবেন।
ধৃতি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল ফের।
৩. ধৃতি মদের ভক্ত নয়
০৩.
ধৃতি মদের ভক্ত নয়। কোনও গোঁড়ামি নেই, কিন্তু মদ খেলেই তার নানারকম শারীরিক অসুবিধে হতে থাকে। কখনও আধকপালে মাথা ধরা, কখনও পেটে প্রচণ্ড গ্যাস জমে, কখনও দমফোট হয়ে হাসফাস লাগে। কাজেই পারতপক্ষে সে মদ হেয় না।
অফিস থেকে আজ একটু আগে আগে কেটে পড়ার তালে ছিল সে। ছটায় ইউ এস আই এস অডিটোরিয়ামে গ্যারি কুপারের একটা ফিল্ম দেখাবে। ধৃতি কার্ড পায়। প্রায়ই ছবি দেখা তার হয়ে ওঠে না। কিন্তু এ ছবিটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তার।
আজ চিফ সাব-এডিটার তারাপদবাবু কাজে বসেছেন। বয়স্ক লোক এবং প্রচণ্ড কাজপাগল। কোন খবরের কতটা ওজন তা তার মতো কেউ বোঝে না।
ধৃতি গিয়ে বলল, তারাপদা, আজ একটু আগে আগে চলে যাব।
যাবে?– বলে তারাপদবাবু মুখ তুলে একটু হেসে ফের বললেন, তোমার আর কী? কর্তারা। ফিচার লেখাচ্ছেন তোমাকে দিয়ে। তুমি হলে যাকে বলে ইম্পর্ট্যান্ট লোক।
এটা অবশ্য ঠেস-দেওয়া কথা। কিন্তু তারাপদবাবুর মধ্যে হিংসা-দ্বেষ বড় একটা নেই। ভালমানুষ রসিক লোক। তাই কথাটার মধ্যে বিষ নেই।
ধৃতি হেসে বলে, ইম্পর্ট্যান্ট নয় তারাদা, আমি হচ্ছি আসলে ইম্পোটেন্ট।
তারাপদবার মুখখানা খুব কেজো মানুষের মতো গভীর করে পিন আঁটা একটা মোটাসোটা খবরের কপি ধৃতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এ খবরটা করে দিয়ে চলে যাও। এটা কাল লিড হতে পারে। বেশি বড় কোরো না।
ঘড়িতে চারটে বাজে। কপি লিখতে ধৃতির আধঘণ্টার বেশি লাগবে না। তাই তাড়াহুড়ো না করে ধৃতি নিজের টেবিলে কপিটা চাপা দিয়ে রেখে সিনেমার ডিপার্টমেন্টে আড্ডা মারতে গেল।
কালীবাবু চুলে কলপ দিয়ে থাকেন। চেহারাখানা জমিদার-জমিদার ধরনের। ভারী শৌখিন লোক। এক সময়ে সিনেমায় নেমেছিলেন, পরে কিছুদিন ডিরেকশন দিলেন। তিন-চারটে ছবি ফ্লপ করার পর হলেন সিনেমার সাংবাদিক। এখন এ পত্রিকার সিনেমার পাতা এডিট করেন।
ধৃতিকে দেখে বলেন, কী ভায়া, হাতে নাকি একটা ভাল মেয়েছেলে আছে! থাকলে দাও না, সিনেমায় নামিয়ে দিই। বাংলা ছবিতে নায়িকার দুর্ভিক্ষ চলছে দেখছ তো?