পরমা ঘরে ঢুকে আসে। হাতে এক কোষ জল। সেটা সজোরে জয়ের গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, সাপ ভাল কি না নিজে জানো না?
ধৃতি বালিশে মুখ গুঁজে বলে, আচ্ছা বাবা, আমিই না হয় সাপ। জয় ভেড়া, আর পরমা সিংহী।
সিংহী না হাতি। পরমার সরোষ উত্তর।
তবে হাতিই। দ্যাট ইজ ফাইনাল। ধৃতি বলে।
জয় হেসে বলে, হাতি বলছে কেন জানো তো! তোমার যে একটু ফ্যাট হয়েছে তাইতেই ওর চোখ টাটায়। ওর গায়ে এক মগ জল ঢেলে দাও।
পরমা ঠিক বলেছ বলে দৌড়ে গেল জল আনতে।
জয় এক প্যাকেট আবদাল্লা সিগারেট ধৃতির বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে বলল, এটা তোর জন্য। রাখ।
ধৃতি পরম আলস্যে পাশ ফিরে প্যাকেটটা কুড়িয়ে নিয়ে বলে, কোথায় পেলি? ফরেনের মাল দেখছি।
অফিসে একজন ক্লায়েন্ট চার প্যাকেট প্রেজেন্ট করে গেল। সদ্য ফরেন থেকে এসেছে।
ধৃতি একটা সিগারেট ধরিয়ে শুয়ে শুয়ে টানে।
জয় বলে, একটু গার্ড নে, পরমা বোধহয় সত্যিই জল আনছে।
মাইরি!–বলে ধৃতি লাফিয়ে ওঠে।
পরমা একটা লাল প্লাস্টিকের মগ হাতে ঘরে ঢুকেই ছুটে আসে। ধৃতি জাপানি ছাতাটা খুলে সামনে ধরতেই পরমা হেসে উঠে বলে, আহা, কী বুদ্ধি।
বলতে বলতে পরমা মগ থেকে জল হাতের আঁজলায় তুলে ওপর বাগে ছিটিয়ে দেয়, নানা কায়দায় ধৃতি ছাতা এদিক ওদিক করে জল আটকাতে আটকাতে বলে, আমি কী করেছি বলো তো?
হাতি বললেন কেন?
মোটেই বলিনি। তুমি বলেছ।
ইস! আপনিই বলেছেন।
মাপ চাইছি।
কান ধরুন।
ধৃতি ছাতা ফেলে কান ধরে দাঁড়ায়।
পরমা মগ রেখে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, মেয়েদের সম্মান করতে কবে যে শিখবেন আপনারা!
কেন, খুব সম্মান করি তো।
করলে জাতটা উদ্ধার পেয়ে যেত।
জয় মৃদু হাসছিল। বলল, ওর কথা বিশ্বাস কোরো না পরমা। ধৃতি এক নম্বরের উওম্যান-হেটার! নারী প্রগতির বিরোধী। আড়ালে ও মেয়েদের নামে যা তা বলে। ও যদি কখনও প্রাইম মিনিস্টার হয় তবে নাকি স্লোগান দেবে, মেয়েরা রান্নাঘরে ফিরে যাও।
বটে?- পরমা চোখ বড় করে তাকায়।
ধৃতি মাথা নেড়ে বলে, মাইরি না। আমি মেয়েদের ক্রিকেট খেলা দেখতেও যাই।
পরমা শ্বাস ফেলে বলে, আমি অবশ্য মেয়েদের ক্রিকেট খেলা পছন্দ করি না। কিন্তু মেয়েদের লিবার্টিকে সাপোর্ট করি।
তোমরা তো ভাই লিবারেটেড। কেউ আজকাল মেয়েদের বাঁধে না! ছাড়া মেয়েরা কেমন চারদিকে পাখি প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ফের? ছাড়া মেয়ে মানে?
মানে যারা লিবারেটেড।
সন্দেহের চোখে চেয়ে পরমা বলে, ব্যাড সেনসে বলছেন না তো?
আরে না।
জয় বলে, ব্যাড সেনসেই বলছে। ওকে ছেড়ো না।
পরমা জয়ের দিকে চেয়ে বলে, তুমি ফুট কাটছ কেন বলো তো?
আমাকে খেপিয়ে দিয়ে বিনি পয়সায় মজা দেখতে চাইছ?
ধৃতি কথাটা লুফে নিয়ে বলে, একজ্যাক্টলি। এবার জয়কেও একটু শাসন করো পরমা, বর বলে অতটা খাতির কোরো না।
কে খাতির করছে?– বলে ধৃতিকে একটা ধমক দিয়ে পরমা জয়কে বলে, আমি জোকার নাকি?
জয় খুব বিষণ্ণ হয়ে বলে, যার জন্য করি ভাল সে-ই বলে চোর!
থাক, আর সাধু সাজতে হবে না।
তুমি নারীরত্ব।
পরমা ঠোঁট উলটে বলে, ডিকশনারি কিংবা বঙ্কিমের বই খুললেই ওসব শব্দ জানা যায়। কমপ্লিমেন্ট দিতেও পারো না বুন্ধু কোথাকার!
তোমার দিকে চাইলে আমার যে কথা হারিয়ে যায়। আত্মহারা হয়ে পড়ি।
খুব সন্তর্পণে ধৃতি বলল, পরমা সুন্দরী।
পরমা বড় বড় চোখে চেয়ে বলে, এটা আবার কবে থেকে?
এইমাত্র মনে এল। ভাল না?
ভেবে দেখি।
বলছিলাম পরমা সুন্দরী, আজকের ডাকে আমার কি কোনও চিঠি এসেছে?
এসেছে, কিন্তু দেব না।
না না, চাইছি না, এলেই হল। আমার যে চিঠি আসছে তার মানে হল এখনও লোকে আমাকে ভুলে যাচ্ছে না, আমি যে বেঁচে আছি তা এখনও কিছু লোক জানে, আর কষ্ট করে যে চিঠি লিখছে তার অর্থ হল আমার মতো অপদার্থকেও লোকের কিছু জানানোর আছে, বুঝলে? চিঠি আসাটাই ইম্পর্ট্যান্ট। চিঠিটা নয়।
ওঃ, খুব ফিলজফার। আচ্ছা দেব না চিঠি।
চাইনি তো। চাইছিও না। ধৃতি বলে।
চাইছে না আবার! ভিতরে ভিতরে ছটফটাচ্ছে! কে চিঠি দিয়েছে বলুন তো? মেয়েলি হাতের লেখা আমি ঠিক চিনি।
হয়তো দিদি। ধৃতি বলে।
না, দিদি নয়, খামের বাঁ দিকে চিঠি যে দিয়েছে তার নাম-ঠিকানা আছে।
তাই বলো! ধৃতি একগাল হেসে বলে, আমি ভাবছি, পরমার এত বুদ্ধি কবে থেকে হল যে হাতের লেখা দেখে মেয়ে না ছেলে বুঝে ফেলবে!
শুনলে পরমা?– জয় ফের খোঁচায়।
পরমা বলে, আমি কালা নই।
তোমাকে বোকা বলছে।
বোকা নয়। ধৃতি বলে, আমি বলতে চাইছি পরমা কুটিল নয়, পরমা সরল ও নিষ্পাপ।
হয়েছে। এই নিন চিঠি। আর আমার সঙ্গে কথা বলবেন না।
বিছানার ওপর একটা খাম ফেলে দিয়ে পরমা চলে যায়।
ধৃতি ঘড়ি দেখে। সময় আছে। চিঠিটা নিয়ে বিছানায় ফের চিতপাত হয়ে শুয়ে পড়ে।
খামের ওপর বাঁধারে লেখা, টুম্পা চৌধুরী। নামের নীচে মধ্য কলকাতার ঠিকানা।
ধৃতি টুম্পা নামে কাউকে মনে করতে পারল না। চিঠি বেশি বড়ও নয়। খুলে দেখল কয়েক ছত্র লেখা-শ্রদ্ধাস্পদেমু, আমার দাদা আপনার সঙ্গে পড়ত। দাদার নাম অশোক চৌধুরী। মনে আছে? একটা দরকারে এই চিঠি লিখছি। আমি একটা ডেফিসিট এ্যান্টের স্কুলে কাজ করি। আমাদের বিল্ডিং-এর জন্য একটা গ্র্যান্ট দরকার। আমরা দরখাস্ত করেছি, কিন্তু ধরা করা ছাড়া তো এসব হয় না। আপনার সঙ্গে তো মিনিস্টারের জানাশোনা আছে। আমি সামনের সপ্তাহে আপনার অফিসে বা বাসায় গিয়ে দেখা করব। প্রণাম জানবেন। টুম্পা চৌধুরী।