.
পরমা নিজেই চা নিয়ে আসে। ধৃতি লক্ষ করে অল্প সময়ের মধ্যেই পরমা শাড়ি পালটেছে। কতবার যে দিনের মধ্যে শাড়ি পালটায় পরমা।
ধৃতি বিছানায় চিতপাত হয়ে পড়েছিল। পরমা বিছানার ওপর এক টুকরো পিসবোর্ডে চায়ের কাপ রেখে রিভলভিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে বলল, আজ নাইট শোতে সিনেমায় যাচ্ছি।
জয়কে খুব ধসাচ্ছ ভাই বন্ধুপত্নী।
আহা, সিনেমায় গেলে বুঝি ধসানো হয়?
শুধু সিনেমা? ফি হপ্তায় যে শাড়ি কিনছ। টি ভি কেনার বায়না ধরেছ। সব জানি। পার্ক স্ট্রিটের হোটেলেও খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে প্রায়ই। পরমা তার প্রিয় মুদ্রাদোষে ঠোঁট উলটে বলে, আমরা তো আর আপনার মতো রসকষহীন হাড়কঞ্জুস নই।
আমি কঞ্জুস?
নয় তো কী? খরচের ভয়ে তো বিয়েই করছেন না। পাছে প্রেমিকাকে সিনেমা দেখাতে কি হোটেলে খাওয়াতে হয় সেই ভয়েই বোধহয় প্রেমেও অরুচি হচ্ছে।
উপুড় হয়ে বুকে বালিশ দিয়ে চায়ে চুমুক মেরে ধৃতি বলল, তোমাদের বিবাহিতদের যা কাণ্ডকারখানা দেখছি এরপর আহাম্মক ছাড়া কে বিয়ে করতে যায়?
মারব থাপ্পড়, কী কাণ্ড দেখলেন শুনি?
রোজ তো তোমাদের দুজনে খটামটি লেগে যায়।
আহা, সে হড়িকলসি এক জায়গায় থাকলে ঠোকাঠুকি হয়ই। তা ছাড়া ওসব ছাড়া প্রেম জমে নাকি? একঘেয়ে হয়ে যায়।
যা-ই বলো ভাই, জয়টার জন্য আমার কষ্ট হয়।
পরমা থমথমে মুখ করে বলে, বললেন তো? আচ্ছা আমিও দেখাচ্ছি। একটা চিঠি এসেছে আপনার। নীল খামে। কিছুতেই সেটা দেব না।
মাইরি?–বলে ধৃতি উঠতে চেষ্টা করে।
পরমা লঘু পায়ে দরজা পেরিয়ে ছুটে চলে যায়। ধৃতি একটু উঠতে চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ওঠে না। চা খেতে থাকে আস্তে আস্তে।
হলঘরে জয়ের গলা পাওয়া যায়, ওঃ, যা একখানা কাণ্ড হয়ে গেল আজ! এই পরমা, শোনো না!
পরমা কোনওদিনই জয়ের ডাকে সাড়া দেয় না। স্বামীরা আজকালকার মেয়েদের কাছে সেকেন্ড গ্রেড সিটিজেন। পরমা কোনও জবাব দিল না।
এই পরমা!— জয় ডাকে।
ভারী বিরক্তির গলায় পরমা বলে, অত চেঁচাচ্ছ কেন বলো তো! এখন যেতে পারছি না।
ডোন্ট শো মি বিজিনেস। কাম হিয়ার। গিভ মি এ–
আঃ! কী যে কোবরা। দাঁড়াও, ধৃতিকে ডাকছি, এসে দেখে যাক।
ওঃ, ধৃতি দেখে কী করবে? হি ইজ ভারচুয়ালি সেক্সলেস। ওর কোনও রি-অ্যাকশন নেই।
পরমা চেঁচিয়ে ডাকল, ধৃতিবাবু! এই ধৃতি রায়!
ধৃতি শান্তভাবে একটা সিগারেট ধরিয়ে অনুচ্চ স্বরে ঘর থেকেই জবাব দেয়, ভাই, তোমাদের বসন্ত-উৎসবে আমাকে ডেকো না। আমি কোকিল নই, কাক।
পরমা পরদা সরিয়ে উঁকি দিয়ে বলে, একজন বিপন্ন মহিলাকে উদ্ধার করা শুরুষের কর্তব্য। আপনাদের শিভালরি কোথায় গেল বলুন তো?
অগাধ জলে। পরমা, আমাদের সব ভেসে গেছে। নারী প্রগতির এই যুগে পুরুষ নাসবন্দি অপদার্থ মাত্র।
পরদার ওপাশে ঝটাপটির শব্দ হয়। আসলে ওটা জয়ের প্রেম নয়, টিকলিং। ধৃতি নির্বিকার ভাবে ধোঁয়ার রিং করার চেষ্টা করতে থাকে শুয়ে শুয়ে। সে জানে জয় সুব্রতর বোনের সঙ্গে একটা রিলেশন তৈরি করেছে সম্প্রতি। জানে বলে ধৃতির এক ধরনের নির্বিকার ভাব আসে। একটু বাদে জয় ঘরে এল। তার পরনে পাজামা, কাঁধে তোয়ালে। হাতে এক গ্লাস ফ্রিজের ঠান্ডা জল। এসে চেয়ারে বসে বলল, দিন দিন ডামি হয়ে যাচ্ছি মাইরি।
মানে?
মানে আর কী? কোথাও আমার কোনও ওপিনিয়ন অ্যাকসেপ্টেড হচ্ছে না। না ঘরে, না বাইরে। কোম্পানি আগ্রার কাছে তাদের প্রোডাকশন তুলে নিয়ে যেতে চাইছে। আমাকে যেতে হবে সাইট আর আদার ফেসিলিটিজ দেখতে। এ নিয়ে আজ চেয়ারম্যানের সঙ্গে দুঘণ্টা মুখের ফেকো তুলে বকলাম। কী মাল মাইরি! আসানসোলে কারখানা খোলবার লেটার অফ ইনডেন্ট পেয়ে গেছে, তবু সেখানে করবে না, আগ্রায় যাবে। হেডং যাকে বলে।
কবে যাচ্ছিস?
ঠিক নেই এখনও। মে বি নেক্সট মান্থ, মে বি নেক্সট উইক, ইভন টুমোরো।
ঘুরে আয়। সেকেন্ড হানিমুন হয়ে যাবে।
আর হানিমুন! ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে লালবাতি জ্বলছে। এই ফ্ল্যাটটা না বেচে দিতে হয়। আজকাল যে যত বড় চাকরি করে তার তত মানিটারি ওবলিগেশন। হা রে, তোরা ট্যাকসেশন নিয়ে কি কিছুই লিখবি না? খোদ আমেরিকায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ পারসেন্টের বেশি ট্যাকসেশন নেই। আর এই ভুখা দেশে কেন এরকম আনহাইজনিক ট্যাকসেশন।
কে জানে!
এটা নিয়ে কিন্তু লেখা দরকার। একটা তিন হাজারি মাস মাইনের লোক আজকাল পুরো প্রলেটারিয়েট। আর ওদিকে যত ট্যাক্স রেট বাড়ছে তত বাড়ছে ট্যাক্স ক্রাইম আর হ্যাঁজার্ডস।
ধৃতি চিত থেকে উপুড় হয়ে বলল, তুই তো এই ফ্ল্যাটটা তোর কোম্পানিকে লিজ দিয়েছিস। তারাই তো ভাড়া গুনছে।
না করে কী করব? টাকা আসবে কোত্থেকে? আমার একমাত্র ট্যাক্স-ফ্রি ইনকাম কোনটা জানিস? তোর দেওয়া মাসে মাসে দুশো টাকা।
ধৃতি একটু লজ্জা পেয়ে চুপ করে থাকে। বাস্তবিকই বড় চাকুরেরা আজকাল সুখে নেই।
জয় কিছুক্ষণ চুপচাপ, ঠান্ডা জল খেল।
ধৃতি বলল, তোর বউ আমার একটা চিঠি চুরি করেছে। মেয়েদের নিন্দে করেছিলাম বলে পানিশমেন্ট।
নিন্দে করেছিস? সর্বনাশ। সে তো সাপের লেজে পা।
ওপাশের হলঘর থেকে পরমা চেঁচিয়ে বলে, খবরদার সাপের সঙ্গে তুলনা দেবে না বলে দিচ্ছি। আমরা কি সাপ?
সাপ কি খারাপ?– জয় প্রশ্ন করে উঁচু স্বরে।