ধৃতি একটু কেঁপে উঠল। বুকটা দুরুদুরু করল। ফোনটা কানে চেপে ধরে বলল, হ্যালো।
ওপাশে সেই কণ্ঠস্বর। একটু কোমল। একটু বিষণ্ণতর।
আপনি না খেয়েই চলে গেলেন।
আপনার লজ্জা করে না?
শুনুন, প্লিজ। রাগ করবেন না।
রাগ করার যথেষ্ট কারণ আছে।
জানি। আমার চেয়ে বেশি সে কথা আর কে জানে? তবু পায়ে পড়ি। রাগ করবেন না।
তা হলে আপনার পরিচয় দিন।
সেটা এখনই সম্ভব নয়। তবে আমি টুপুর মা নই।
তবে কি আপনি টুপু?
উঃ, কী যে সব বলছেন না! আপনার টেবিলের লোক নিশ্চয়ই শুনছে আর হাঁ করে চেয়ে আছে!
উমেশবাবু ঠিক হাঁ করে চেয়ে ছিলেন না। তবে স্বভাবসিদ্ধ তলচোখের চাউনিটা ধৃতির দিকেই নিবদ্ধ রেখেছেন। ধৃতি গলা আরও নামিয়ে বলল, পরিচয় না দিলে আর কোনও কথা নেই।
আপনি সবই জানতে পারবেন। শুধু একটু যদি সময় দেন।
ধৃতি দৃঢ় গলায় বলে, আর নয়। সময় এবং প্রশ্রয় আমি অনেক দিয়েছি আপনাকে। আজ রীতিমতো অপ্রস্তুত হতে হয়েছে। আপনি এতটা কেন করলেন? আমি তো কোনও ক্ষতি করিনি। আপনার!
না। আপনার মতো ভদ্রলোক হয় না। আমি কাণ্ডটা করেছি শুধু টুপুর মায়ের অবস্থাটা আপনি নিজের চোখে দেখবেন বলে।
তাতে কী লাভ? আমি তো কিছু করতে পারব না।
আপনি কি জানেন যে টুপুর মায়ের অনেক সম্পত্তি?
না। আপনার মুখে শুনেছি মাত্র।
বিশ্বাস করুন, সম্পত্তি জিনিসটা খুবই খারাপ। টুপু ছিল সেই সম্পত্তির ওয়ারিশান।
তা হবে। শুনে আমার লাভ কী?
আপনার লাভ না হলেই কি কিছু নয়? ধৈর্য ধরে একটু শুনবেন তো!
শুনছি।
টুপুর মৃত্যুসংবাদ আমি রটাতে চেয়েছিলাম টুপুর জন্যেই। আমার বিশ্বাস টুপু বেঁচে আছে। কিন্তু ওর আত্মীয়রা ওকে বেঁচে থাকতে দিতে চায় না। মৃত্যুসংবাদ রটে গেলে ও নিরাপদ। কেউ আর ওকে মারতে চাইবে না।
কেন? টুপুর মৃত্যুতে তাদের কী লাভ?
টুপু বেঁচে থাকলে ওদের চলবে কী করে? অত বড় বাড়ি দেখলেন, কিন্তু ফেঁপড়া। কিছু নেই। ওদের। পুরো সংসার চলছে টুপুদের টাকায়।
এত কথা আমাকে বলছেন কেন?
তা জানি না। বোধহয় কাউকে জানানো দরকার বলে জানাচ্ছি।
তা হলে আইনের আশ্রয় নিন, উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করুন। পুলিশেও যেতে পারেন।
আমি কে যে সেসব করতে যাব?
তবে আমিই বা কে?
একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল, তা অবিশ্যি সত্যি। আপনাকে আজ হয়রান করা আমার হয়তো উচিত হয়নি, আপনি রেগে আছেন।
তা আছি।
আপনার অফিসে টেলিফোনের ডাইরেক্ট লাইন নেই? থাকলে দিন না। পি বি এক্স লাইনে তো কোনও কথাই গোপন থাকে না।
আর কী বলার আছে আপনার?
প্লিজ, দিন। আর টেলিফোনের কাছে থাকুন দয়া করে। আমি এক্ষুনি রিং করব।
ধৃতি রিপোর্টিং-এর একটা নম্বর দিল এবং ফোনটা রেখে রাগে ভিতরে ভিতরে গজরাতে গজরাতে টেলিফোনটার কাছে গিয়ে বসল। এখন রিপোর্টিং ফঁকা। প্রায় সবাই বেরিয়ে গেছে।
ফোনটা বাজতেই লাইন ধরল ধৃতি, হ্যাঁ বলুন।
আপনিই তো?
তবে আর কে হবে?
একটু হাসি শোনা গেল, না মানে ভীষণ ভয় করে। কী করছি কে জানে!
মজা করছেন। আর কী?
মোটেই না। রেগে আছেন বলে আপনি আমার সমস্যা বুঝতে চাইছেন না।
আপনি কে আগে বলুন। তারপর অন্য কথা।
বলব। একটু ধৈর্য ধরুন। আগে আর দু-একটা কথা বলার আছে।
বলে ফেলুন, কিন্তু প্লিজ আর গল্প ফেঁদে বসবেন না।
টুপু একটু অন্যরকম ছিল। খুব ভাল মেয়ে নয়। অনেক অ্যাফেয়ার ছিল তার।
বিরক্ত হয়ে ধৃতি বলে, এরকম কথা আগেও শুনেছি।
আর একটু শুনুন। প্লিজ।
সংক্ষেপে বলুন।
টুপু অবশেষে একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায়। ছেলেটা বাজে। কিন্তু টুপুও ভাল নয়। ছেলেটার রোজগারপাতি কিছু ছিল না। তবে খুব হ্যান্ডসাম ছিল, আর সেইটেই একমাত্র তার প্লাস পয়েন্ট। রূপনারায়ণপুরে তারা কিছুদিন ঘরভাড়া করেছিল। তারপর ছেলেটা পালায়। টুপুর তাতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। চেহারা সুন্দর বলে আবার একজন জুটে যায়। এ বড় কন্ট্রাক্টর। বিবাহিত। ক্রমে টুপু গাঁজা, মদ, ড্রাগের নেশা করতে থাকে। একসময়ে তার জীবনে একটা গভীর জটিল অন্ধকার নেমে আসে। সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিল একবার। পারেনি।
ধৃতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সে এখনও বেঁচে আছে জানলেন কী করে?
জানি না। অনুমান করি।
অনুমানের কোনও বেস নেই?
আছে। টুপু এখনও রূপনারায়ণপুরে আছে বলে খবর পেয়েছি।
আপনি কি তাকে উদ্ধার করতে চান?
যদি চাই, তা হলে সেটা খুব অসম্ভব কিছু মনে হচ্ছে কি?
হচ্ছে। কারণ এসব মেয়েরা বড় একটা ফেরে না। মূল উপড়ে ফেললে কি গাছ বাঁচে?
যদি টুপুর অনুশোচনা এসে থাকে?
ধৃতি একটু হাসল, অনুশোচনা জিনিসটা ভাল। কি ফেরার পথটাও যে বন্ধ। সংসার তো তার জন্য কোল পেতে বসে নেই। সে এখন কীরকম জীবন কাটাচ্ছে তার খবর রাখেন?
খুব লোনলি।
পুরুষ সঙ্গী কেউ নেই?
না। টুপুকে এখন সবাই ভয় পায়। তার রূপ গেছে, টাকা নেই, নেশা করে করে কেমন যেন বেকুবের মতোও হয়ে গেছে।
তার চলে কী করে?
যেভাবে চলে তাকে ঠিক চলা বলে না বোধহয়। ধরুন একরকম ভিক্ষে করেই চলে।
ভিক্ষে?
শুনেছি সে একটা নাচগানের স্কুল করছে।
কীরকম স্কুল? চালু?
সে সেই স্কুলে চাকরি করে। নাচ গান শেখায়, সামান্য মাইনে।
তবে তো সে ভালই আছে।
না, মোটেই ভাল নেই। সে ফিরতে চায়।
ফিরতে বাধা কী?
সবচেয়ে বড় সমস্যা হল কোথায় সে ফিরবে?
কেন? নিজেদের এলাহাবাদের বাড়িতে?