কোন ঘরটা বলুন তো? ধৃতি জিজ্ঞেস করে।
ওই তো দরজা। ঠেলে ঢুকে যান।
ধৃতির হাত-পা ঠান্ডা আর অবশ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, গোটা ব্যাপারটাই একটা সাজানো ফাঁদ নয় তো? কিন্তু সামান্য একটু রোবও আছে ধৃতির। যে কোনও ঘটনারই শেষ দেখতে ভালবাসে।
দ্বিধা ঝেড়ে সে ডান দিকের দরজাটা ঠেলে ঘরে ঢুকল।
প্রকাণ্ড ঘর। খুব উঁচু সিলিং মেঝে থেকে জানালা। ঘরের মধ্যে এক বিশাল পালঙ্ক, কয়েকটা পুরনো আমলের আসবাব, অর্গান, ডেক্স, চেয়ার, বুকশেলফ, আলনা, থ্রি পিস আয়নার ড্রেসিং টেবিল, আরও কত কী।
খাটের বিছানায় এক প্রৌঢ়া রোগা-ভোগা চেহারার মহিলা শুয়ে আছেন। চোখ বোজা। গলা পর্যন্ত টানা লেপ। বালিশে কাঁচা-পাকা চুলের ঢল। একসময়ে সুন্দরী ছিলেন, এখনও বোঝ যায়।
ধৃতি শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করল যাতে উনি চোখ মেলেন।
মেললেন এবং ধীর গম্ভীর গলায় বললেন, কে?
আমি ধৃতি। ধৃতি রায়।
ধৃতি রায়! কে বলো তো তুমি?
আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?
না তো! হ্যারিকেনটা উসকে দাও তো। তোমাকে দেখি।
এখন তো দিনের আলো।
কোথায় আলো? আলো আবার কবে ছিল? তোমার সাঁইথিয়ায় বাড়ি ছিল না?
না।
টুপুর মা উঠে বসেছেন। চোখে খর অস্বাভাবিক দৃষ্টি।
কার খোঁজে এসেছেন?
আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন ফোনে। মনে নেই?
ও তাই বলো। তা বোসো বোসো। আমি খুব ফোনের শব্দ পাই, বুঝলে! কেন পাই বলো তো! এত ফোন কে কাকে করে জানো?
না।
টুপুর মার পরনে থান, গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মালা, মুখে প্রাচীন সব আঁকিবুকি। টুপুর মার যে গলা ধৃতি টেলিফোনে শুনেছে এর গলা মোটেই তেমন নয়।
তুমি কে বললে?
ধৃতি রায়। আমি খবরের কাগজে লিখি।
খবরের কাগজ! এখন পুরনো খবরের কাগজ কত করে কিলো যাচ্ছে বলো তো! আমাকে সেদিন একটা কাগজওয়ালা খুব ঠকিয়ে গেছে।
জানি না।
তোমার দাড়িপাল্লা কোথায়? বস্তা কোথায়?
আমি কাগজওয়ালা নই।
শিশি-বোতল নেবে? অনেক আছে।
ধৃতি ফাপড়ে পড়ে ঠোঁট কামড়াতে লাগল। সন্দেহের লেশ নেই, সে ভুল জায়গায় এসেছে, ভুলে পা দিয়েছে। তবু মরিয়া হয়ে সে বলল, আপনি আমাকে ফোন করে টুপুর খবর দিয়েছিলেন, মনে নেই? এলাহাবাদ থেকে ট্রাঙ্ককল।
টুপুর মা অন্যদিকে চেয়ে বললেন, সে কথাই তো বলছি তোমাকে বাগদি বউ, অত ঘ্যানাতে নেই। পুরুষমানুষ কি ঘ্যানানি ভালবাসে?
ধৃতি একটু একটু ঘামছে।
আচমকাই সে আয়নায় দেখল, দরজাটা সাবধানে ফাঁক করে ঝিটা উঁকি দিল।
শুনছেন?
ধৃতি ফিরে চেয়ে বলল, কী?
উনি কি আপনার কেউ হন?
না। চেনাও নয়। ফোন পেয়ে এসেছি।
আপনি একটু বাইরে আসুন। মেজ গিন্নিমা ডাকছেন।
ধৃতি হাঁফ ছেড়ে উঠে পড়ল। টুপুর মা তাকে আর আমল না দিয়ে ফের গায়ে লেপ টেনে শুয়ে পড়ল।
সাবধানে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ঝি বলল, ওই ঘর, চলে যান।
মেজ গিন্নিমা কে?
উনিই কর্ত্রী। যান না।
ধৃতি এগোল। এ ঘরের দরজা খোলা এবং সে ঘরে ঢোকার আগেই পর্দা সরিয়ে একজন অত্যন্ত ফরসা ও মোটাসোটা মহিলা বেরিয়ে এসে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, আসুন ভাই, ভিতরে আসুন।
ঘরটা বেশ আধুনিক কায়দায় সাজানো। যদিও প্রকাণ্ড, সোফা সেট আছে, দেয়ালে যামিনী রায় আছে।
তাকে বসিয়ে ভদ্রমহিলা মুখোমুখি একটা মোড়া টেনে বসে বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো! টুপুর মা নাকি আপনাকে ডেকে এনেছে? কী কাণ্ড।
ধৃতি থমথমে মুখ করে বলল, কোথাও একটা বিরাট ভুল হয়ে গিয়ে থাকবে। তবে আপনি শুনতে চাইলে ব্যাপারটা ডিটেলসে বলতে পারি।
বলুন না। আগে একটু চা খেয়ে নিন, কেমন?
ভদ্রমহিলা উঠে গেলেন। একটু বাদে চা এল, একটু সন্দেশের জলখাবারও।
ধৃতি শুধু চা নিল, তারপর মিনিট পনেরো ধরে আদ্যোপান্ত বলে গেল ঘটনাটা।
ভদ্রমহিলা স্থিরভাবে বসে শুনলেন। কোনও উঃ, আঃ, আহা, তাই নাকি, ওমা এসব বললেন না। সব শোনার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমার আশ্চর্য লাগছে কী জানেন?
কী বলুন তো?
টুপুর ঘটনাটা মোটেই মিথ্যে নয়। এরকমই ঘটেছিল। তবে তা ঘটেছিল বছর সাতেক আগে। সেই থেকে টুপুর মা কেমন যেন হয়ে গেলেন। এখন আমরা আশা ছেড়ে দিয়েছি। যতদিন বাঁচবেন ওরকমই থাকবেন। তবে গল্পটার শেষটাই রহস্য। আপনাকে যে ফোন করত সে আর যেই হোক টুপুর মা নয়।
তা হলে কে?
ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে বললেন, উনি ঘর থেকেই বেরোন না। ফোন করতে জানেনও না বোধহয়। তবে যেই করুক সে আমাদের অনেক খবর রাখে।
টুপ কি সত্যিই মারা গেছে?
মাথা নেড়ে ভদ্রমহিলা বললেন, বলা অসম্ভব। পুলিশও কোনও হদিশ পায়নি। কোথায় যে গেল মেয়েটা।
কিছু মাইন্ড করবেন না, উনি মানে টুপুর মা আপনার কে হন?
আমার বড় জা। ওঁরা তিন ভাই। বড় জন নেই, ছোট অর্থাৎ আমার দেওর আমেরিকায় থাকে। ওখানকারই সিটিজেন। ছুটি কাটাতে এসেছে। দুভাই মিলে আজ মাছ ধরতে গেছে ব্যান্ডেলে।
নীচের তলায় যে দুটি ছেলেমেয়েকে টেবিল টেনিস খেলতে দেখলাম ওরা কারা? আপনার দেওরের ছেলেমেয়ে?
হ্যাঁ। বলে মেজগিন্নি একটু তেড়চা হেসে বললেন, একেবারে সাহেব-মেম। এ দেশের কিছুই পছন্দ নয়। কেবল নাক সিটকে থাকে সবসময়।
আপনার ছেলেমেয়েরা কোথায়?
মেয়ে শান্তিনিকেতনে। ছেলে দুটি। দুজনেই বাঙ্গালোরে ডাক্তারি পড়ে।
বাঙ্গালোরে কেন?
আমরা ওখানেই থাকর্তামা । আমার হাজব্যান্ডের তখন ওখানে একটা পার্টনারশিপের ব্যাবসা ছিল। উনি একটু খেয়ালি। হঠাৎ ভাল লাগছে না বলে নিজের শেয়ার বেচে চলে এলেন। ছেলেরা হস্টেলে থাকে।