সকালে ধৃতি চা খেল তিন কাপ।
পরমা বলল, চায়ের কেজি কত তা মশাইয়ের জানা আছে?
কেন, চা-টা তো সেদিন আমিই কিনে আনলাম। লপচুর হাফ কেজি।
ও, আপনার পয়সায় কেনাটা বুঝি কেনা নয়?
মাইরি, তুমি জ্বালাতেও পারো।
আর শুধু চা নিলেই তো হবে না। দুধ চিনি এসবও লাগে।
পরেরবার চিনি দুধ ছাড়াই দিয়ো।
আর দিচ্ছিই না। চিনি দুধ লিকার কোনওটাই পাচ্ছেন না আপনি।
আজ নার্ভ শক্ত রাখতে হবে পরমা। আজ এক রহস্যময়ীর সঙ্গে রহস্যময় সাক্ষাৎকার।
আহা, রহস্যের রস তো খুব। মাঝবয়সি আধপাগল এক মহিলা, তার আবার রহস্য কীসের? খুব যে রহস্যের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে।
স্বপ্ন নয় হে, স্বপ্ন হলে তো বাঁচতাম। কী কুক্ষণেই যে নেমন্তন্নটা অ্যাকসেপ্ট করেছিলাম।
আবার ফোন করুন না, নেমন্তন্ন ক্যানসেল করে দিন। ভিতুর ডিমদের এইসব কাজ করতে যাওয়াই ঠিক নয়। এখন দয়া করে আসুন, রোগা শরীরে খালিপেটে চা না গিলে একটু খাবার খেয়ে উদ্ধার করুন।
তোমার ব্রেকফাস্টের মেনু কী?
লুচি আর আলুভাজা।
কুকিং মিডিয়াম কি বনস্পতি নাকি?
কেন? গাওয়া ঘি চাই নাকি? গরিবের বাড়ি এটা, মনে থাকে না কেন? এখনও ফ্ল্যাটের দাম শোধ হয়নি।
ধৃতি ওঠার কোনও লক্ষণ প্রকাশ করল না। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ছেলেবেলায় কখনও এই অখাদ্যটা কারও বাড়িতে তেমন ঢুকতে দেখিনি। বনস্পতি হল পোস্ট-পার্টিশন বা সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার সিনেমা। কে ওটা আবিষ্কার করেছে জানো?
না। গরিবের কোনও বন্ধু হবে।
তার ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল।
আর বনস্পতির নিন্দে করতে হবে না। আমাদের পেটে সব সয়।
ছাই সয়। সাক্ষাৎ বিষ।
আচ্ছা, আচ্ছা, বুঝেছি। রুগি, মানুষকে বনস্পতি খাওয়াব আমি তেমন আহাম্মক নই। ময়দায় ঘিয়ের ময়েন দিয়ে বাদাম তেলে ভাজা হচ্ছে। ভয় নেই, আসুন।
ধৃতি বিরস মুখে বলে, এর চেয়ে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট ভাল ছিল পরমা। টোস্ট, ডিম, কফি।
কাল থেকে তাই হবে। খাটুনিও কম।
ধৃতি উঠল, খেল। তারপর দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে স্নান করে প্রস্তুত হতে লাগল।
পরমা হঠাৎ উড়ে এসে ঘরে ঢুকে বলল, কী ড্রেস পরে যাচ্ছেন দেখি! এ মা! ওই সাদা শার্ট আর ভুসকো প্যান্ট! আপনার রুচি-টুচি সব যাচ্ছে কোথায় বলুন তো!
কেন, এই তো বেশ। তা হলে কী পরব?
সেই নেভি ব্লু প্যান্টটা কোথায়?
আছে।
আর মাল্টি কালার স্ট্রাইপ শার্ট?
আছে বোধহয়।
ওই দুটো পরে যান।
অগত্যা ধৃতি তাই পরল। পরমা দেখে-টেখে বলল, মন্দ দেখাচ্ছে না। রুগ্ন ভাবটা আর চোখে পড়বে না বোধহয়।
ধৃতির পোশাকের দিকে মন ছিল না। মনে উদবেগ, অস্বস্তি। রওনা হওয়ার সময় পরমা দরজার কাছে এসে বলল, অফিসে গিয়ে একবার ফোন করবেন। লালিদের ফ্ল্যাটে আমি ফোনের জন্য অপেক্ষা করব।
কেন পরমা, ফোন করব কেন?
একটু অ্যাংজাইটি হচ্ছে।
এই যে এতক্ষণ আমাকে সাহস দিচ্ছিলে!
ভয়ের কিছু নেই জানি, কিন্তু আপনার ভয় দেখে ভয় হচ্ছে। করবেন তো ফোন? তিনটে পনেরো মিনিটে।
আচ্ছা। তা হলে আমার জন্য তুমি ভাবো?
যা নাবালক! ভাবতে হয়।
ধৃতি একটু হালকা মন নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
টুপুর মায়ের ঠিকানা খুব জটিল নয়। বড়লোকদের পাড়ায় বাস। সুতরাং খুঁজতে অসুবিধে হল না।
ট্যাকসি থেকে নেমে ধৃতি কিছুক্ষণ হাঁ করে বাড়িটা দেখল। বিশাল এবং পুরনো বাড়ি। জরার চিহ্ন থাকলেও জীর্ণ নয় মোটেই। সামনেই বিশাল ফটক। ফটকের ওপাশ থেকেই অন্তত দশ গজ চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে উঁচু প্রকাণ্ড বারান্দায়। বারান্দায় মস্ত গোলাকার থামের বাহার। তিনতলা বাড়ি, কিন্তু এখনকার পাঁচতলাকেও উচ্চতায় ছাড়িয়ে বসে আছে।
ফটকে প্রকাণ্ড গোঁফওয়ালা এক দারোয়ান মোতায়েন দেখে ধৃতি আরও ঘাবড়ে গেল।
দারোয়ান ধৃতিকে ট্যাকসি থেকে নামতে দেখেছে। উপরন্তু ওর পোশাক-আশাক এবং চেহারাটা বোধহয় দারোয়ানের খুব খারাপ লাগল না। ধৃতি সামনে যেতেই টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটা সেলাম গোছের ভঙ্গি করে ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞেস করল, কাকে চাইছেন?
টুপুর মা। মানে
দারোয়ান গেটটা হড়াস করে খুলে দিয়ে বলল, যান।
ধৃতি অবাক হল। যাবে, কিন্তু কোথায় যাবে? বাড়িটা দেখে তো মনে হচ্ছে সাতমহলা। এর কোন মহল্লায় কে থাকে তা কে জানে?
ধৃতি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। তার কেমন যেন এই দুপুরেও গা ছমছম করছে। মনে হচ্ছে, আড়াল থেকে খুব তীক্ষ্ণ নজরে কেউ তাকে লক্ষ করছে।
বারান্দায় পা দিয়ে ধৃতি দেখল, একখানা হলঘরের মতো প্রকাণ্ড জায়গা। সবটাই মার্বেলের মেঝে। বারান্দার তিনদিকেই প্রকাণ্ড তিনটে কাঠের ভারী পাল্লার দরজা। দুপাশের দরজা বন্ধ, শুধু সামনেরটা খোলা।
ধৃতি পায়ে পায়ে এগোল।
দরজার মুখে দ্বিধান্বিত ধৃতি দাঁড়িয়ে পড়ল। এরকম পুরনো জমিদারি কায়দার বাড়ি ধৃতি দূর থেকে দেখেছে অনেক, তবে কখনও ভিতরে ঢোকার সুযোগ হয়নি। এইসব বাড়িতেই কি একদা ঝাড়-লণ্ঠনের নীচে বাইজি নাচত আর উঠত ঝনঝন মোহরের প্যালা ফেলার শব্দ? এইসব বাড়িরই অন্দরমহলে কি গভীর রাত অবধি স্বামীর প্রতীক্ষায় জেগে থেকে অবিরল অমোচন করত অন্তঃপুরিকারা? চাষির গ্রাস কেড়ে নিয়েই কি একদা গড়ে ওঠেনি এইসব ইমারত? এর রঙ্গে রঙ্গে কি ঢুকে আছে পাপ আর অভিশাপ?
বাইরের ঘরটা বিশাল। এতই বিশাল যে তাতে একটা বাস্কেটবলের কোর্ট বসানো যায়। সিলিং প্রায় দোতলার সমান উঁচুতে। কিন্তু আসবাব তেমন কিছু নেই। কয়েকটা পুরনো প্রকাও কাঠের আলমারি দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো। ঘরের মাঝখানে একটা নিচু তক্তপোশে সাদা চাদর পাতা, কয়েকটা কাঠের চেয়ার, মেঝেয় ফাটল, দাগ। দেয়ালে অনেক জায়গায় মেরামতির তাড়ি। তবু বোঝা যায়, এ বাড়ির সুদিন অতীত হলেও একেবারে লক্ষ্মীছাড়া হয়নি।