খুব ডিটেকশন শিখেছেন।
তবে আজ এত সাজের কী হল?
বাঃ, সাজটাই বা কী করেছি। মুগার শাড়িটা অনেককাল পরি না, একটু পরেছি, তাই আবার একজনের চোখ কটকট করছে।
আহা, অত ঝলমলে জিনিস চোখে একটু লাগবেই। ব্যাপারটা একটু খুলে বললেই তো হয়। কেসটা কী?
পরমা খোঁপার মাথাটা ঠিক করতে করতে বলল, ফ্ল্যাটবাড়ি হল একটা কমিউনিটি, জানেন তো!
জানব না কেন, বুদ্ধ নাকি? ছমাস আগেই কলকাতার এই ফ্ল্যাটবাড়ির নিয়ো কমিউনিটি নিয়ে ফিচার লিখেছিলাম।
জানি। পড়েওছি। ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকতে গেলে সকলের সঙ্গে বোঝাপড়া রেখে চলতে হয়। আজ দোতলায় দোলাদের ফ্ল্যাটে চায়ের নেমন্তন্ন ছিল। ওদের মেয়ের জন্মদিন।
খুব খাওয়াল?
প্রচুর। মুরগি, গলদা, ভেটকি ফ্রাই, ফিশ রোল, লুচি, ফ্রায়েড রাইস, পায়েস..
রোখকে ভাই। তুমি ক্যালোরি হিসেব করে খাও না নাকি?
তার মানে?
ওরকম গান্ডেপিন্ডে খেলে যে দুদিনেই হাতির মতো হয়ে যাবে।
আহা, আমার ফিগার নিয়ে ভেবে ভেবে তো চোখে ঘুম নেই। আমি অত বোকা নই মশাই, একখানা মুরগির ঠ্যাং দুঘণ্টা ধরে চিবিয়ে এসেছি মাত্র।
রোল খাওনি?
আধখানা।
গলদা ছেড়ে দিলে? চল্লিশ টাকা কিলো যাচ্ছে।
ওই একটু।
দইটা কেমন ছিল?
দই। না, দই করেনি তো। আইসক্রিম।
কেমন ছিল?
বাঃ, আইসক্রিম আবার কেমন হবে? ভালই।
মিষ্টির আইটেম করেনি তা হলে। ছ্যাঁচড়া আছে।
মোটেই না। তিনরকম সন্দেশ ছিল মশাই।
ধৃতি মাথা নেড়ে বলল, না। তোমার ফিগার কিছুতেই রাখতে পারবে না পরমা। এত যে কেন খাও।
নজর দেবেন না বলছি।
দিচ্ছি না। কেউ আর দেবেও না।
খুব হয়েছে। দোলা আপনার জন্যও চর্বচোষ্য পাঠিয়েছে। এতক্ষণ ঘরে সেগুলো নিচু আঁচে রেখে বসে আছি। দয়া করে এবার গিলুন।
আমার জন্য। আমার জন্য পাঠাবে কেন? তারা কি আমাকে চেনে?
এমনিতে চেনে না। তবে প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে দহরম-মহরম আছে মনে করে হঠাৎ চিনতে শুরু করেছে। যান তো, তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন।
ধৃতি হাত-মুখ ধুয়ে এল বটে, কিন্তু মুখে এক বিচ্ছিরি অরুচি জ্বরের পর থেকেই তার খাওয়ার আনন্দকে মাটি করে দিয়েছে। টেবিলে বসে বিপুল আয়োজনের দিকে চেয়ে সে শিউরে উঠে বলল, এক কাজ করা পরমা, মুরগি আর লুচি বাদে সব সরিয়ে নাও। ফ্রিজে রেখে দাও, পরে খাওয়া যাবে।
অরুচি হচ্ছে, না?
ভীষণ খাবার দেখলেই এলার্জি হয় যেন।
কী করি বলুন তো আপনাকে নিয়ে!
আমাকে নিয়ে তোমার অনেক জ্বালা আছে ভবিষ্যতে। বুঝবে।
এখনই কি বুঝছি না নাকি?
বলে পরমা সযত্নে তাকে খাবার বেড়ে দিল। একটা বাটিতে খানিকটা চাটনি দিয়ে বলল, এটা মুখে দিয়ে দিয়ে খাবে, রুচি হবে।
খেতে খেতে ধৃতি বলল, একটা মুশকিল হয়েছে পরমা।
কী মুশকিল?
টুপুর মা নেমন্তন্ন করেছে কাল।
কে টুপুর মা?
ওই যে সেদিন সুন্দর মেয়েটার ফোটো দেখলে, মনে নেই?
ওঃ, তা সে তো মরে গেছে।
বটেই তো, কিন্তু তার মা তো মরেনি!
নেমন্তন্নটা কীসের?
বোধহয় একটু আলাপ করতে চান।
আলাপও নেই?
নাঃ, শুধু ফোনে কথা হত।
কী বলতে চায় মহিলা?
তা কী করে বলব? হয়তো টুপুর কথা।
বেচারা।
যাব কি না ভাবছি।
যাবেন না কেন?
একটু ভয়-ভয় করছে। অচেনা বাড়ি, অচেনা ফ্যামিলি…
তাতে কী, আলাপ হলেই অচেনা কেটে গিয়ে চেনা হয়ে যাবে। আপনি অত ভিতু কেন?
আমি খুব ভিতু বুঝি?
ভিতু নন? আমার সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে থাকতে হচ্ছে বলে ভয়ে কাঁটা হয়ে আছেন।
ধৃতি চোখদুটো একটু বুজে রেখে খুব নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করল, তোমার কোচটি কে বলো তো?
কোচ। কীসের কোচ?
তোমাকে এইসব আধুনিক কথাবার্তার ট্রেনিং দিচ্ছে কে?
কেন? আমার বুঝি কথা আসে না?
খুব আসে, হাড়ে হাড়ে আসে, কিন্তু ভাই বন্ধুপত্নী, তুমি তো এত প্রগতিশীলা ছিলে না এতদিন।
হচ্ছি। আপনার পাল্লায় পড়ে। সে যাক গে, সব সময়ে অত ইয়ারকি ভাল নয়। ভদ্রমহিলা ডাকল কেন সেটা ভেবে দেখা ভাল।
আমি বলি কী পরমা, মেয়েছেলের কেস যখন তুমিও সঙ্গে চল।
আমি! ওমা, আমাকে তো নেমন্তন্ন করেনি।
গুলি মারা নেমন্তন্ন।
তা হলে কী বলে গিয়ে দাঁড়াব? একটা কিছু পরিচয় তো চাই।
বউ বলেই চালিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু আমি যে ব্যাচেলর তা ভদ্রমহিলা জানেন।
ইস, ওঁর বউ সাজতে বয়ে গেছে।
একটা কাজ করা যাক পরমা, গিয়ে দুজনে আগে হাজির হই। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
পরমা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, ইচ্ছে করছে না এমন নয়। কিন্তু আমার মনে হয় আপনার এত উদবেগের কোনও কারণ নেই। গিয়ে দেখেই আসুন না।
ধৃতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলল, তাই হবে। বোধহয় তুমি ঠিকই বলছ।
পরমা কিছুক্ষণ ধৃতির দিকে চেয়ে রইল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, রাত হয়েছে। রোগা শরীরে আর জেগে থাকতে হবে না। শুয়ে পড়ুন গে। শুয়ে শুয়ে ভাবুন।
ধৃতি উঠল।
৮. নিরস্ত্র এবং অসহায় ধৃতি
০৮.
এত নিরস্ত্র এবং এত অসহায় ধৃতি এর আগে কদাচিৎ বোধ করেছে। মেয়েদের সম্পর্কে তার কোনও অকারণ দুর্বলতা বা ভয়-ভীতি নেই। কিন্তু এই এলাহাবাদি ভদ্রমহিলা সম্পর্কে একটা রহস্যময়তার বোধ জমেছে ধৃতির। মহিলার কথাবার্তায় উলটোপালটা ব্যাপার আছে, মানসিক ভারসাম্যও হয়তো নেই। একটু যেন বেশি গায়ে-পড়া। তাছাড়া এলাহাবাদের ট্রাঙ্ককল, চিঠিতে পোস্ট অফিসের ছাপ এবং টুপুর ছবি এর সব কটাই সন্দেহজনক। কাজেই ভদ্রমহিলার মুখোমুখি হতে আজ ধৃতির খুব কিন্তু কিন্তু লাগছিল।