এত রাতে আর ঝামেলায় যেয়ো না। আমি অনেকটা ভাল ফিল করছি।
একশো চার জ্বরে কেমন ভাল ফিল করে লোকে তা জানি।
তুমি সত্যিই জেগে থাকবে নাকি?
থাকব তো বলেছি।
ধৃতি পরমার দিকে তাকাল। আবছা আলোয় এক অদ্ভুত রহস্যময় সৌন্দর্য ভর করেছে পরমার শরীরে। এলো চুলে ঘেরা মুখখানা যে কী অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু ধৃতি পরমার প্রতি কখনওই কোনও শারীরিক আকর্ষণ বোধ করেনি। আজও করল না। কিন্তু মেয়েটার প্রতি সে এক অদ্ভুত ব্যাখ্যাতীত মায়া আর ভালবাসা টের পাচ্ছিল। জ্বরতপ্ত দুখান্না হাতে পরমার হাতখানা নিজের কপালে চেপে ধরে ধৃতি বলল, তোমার মনটা যেন চিরকাল এরকমই থাকে পরমা। তুমি বড় ভাল।
হঠাৎ পরমার মুখখানা তার মুখের খুব কাছাকাছি সরে এল।
গাঢ়স্বরে পরমা বলল, আর কমপ্লিমেন্ট দিতে হবে না। এখন ঘুমোন।
ধৃতি ঘুমোল। এক ঘুমে ভোর।
জ্বরটা ছাড়লেও দিন দুই বেরোতে পারেনি ধৃতি। তিনদিনের দিন অফিসে গেল।
ফোনটা এল চারটে নাগাদ।
এ কদিন অফিসে আসেননি কেন? আমি রোজ আপনাকে ফোন করেছি।
ধৃতি একটু শিহরিত হল গলাটা শুনে। বলল, আমার জ্বর ছিল।
আপনার গলার স্বরটা একটু উইক শোনাচ্ছে বটে। যাই হোক, সেদিন পি এম-এর সঙ্গে আপনার ইন্টারভিউয়ের রিপোর্ট কাগজে পড়েছি। বেশ লিখেছেন। কিন্তু আপনারা কেউই পি এম-কে তেমন অস্বস্তিতে ফেলতে পারেননি।
পি এম অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। তাকে রংফুটে ফেলা কি সহজ?
তা বটে।
আপনি এখনও এলাহাবাদে ফিরে যাননি?
না। রোজই যাব যাব করি। কিন্তু একটা না একটা বাধা এসে যায়। আবার ভাবি, গিয়েই বা কী হবে। টুপু নেই, ফাঁকা বাড়িতে একা একা সময়ও কাটে না ওখানে।
এখানে কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন?
এখানে! ও বাবাঃ, কলকাতায় কি সময় কাটানোর অসুবিধে? ছবির একজিবিশনে যাই, ক্লাসিক্যাল মিউজিক শুনি, থিয়েটার দেখি, মাঝে মাঝে সিনেমাতেও যাই, আর ঘুরে বেড়ানো বা মার্কেটিং তো আছেই।
হ্যাঁ, কলকাতা বেশ ইন্টারেস্টিং শহর।
আপনারও কি কলকাতা ভাল লাগে?
লাগে বোধহয়, ঠিক বুঝতে পারি না।
বাড়িতে আপনার কে কে আছে?
আমার! আমার প্রায় কেউই নেই। এক বন্ধুর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকি।
ওমা। বলেননি তো কখনও?
এটা বলার মতো কোনও খবর তো নয়।
আপনার মা বাবা নেই?
না।
ভাই বোন?
আছে, তবে না থাকার মতোই।
আপনি তা হলে খুব একা?
হ্যাঁ।
ঠিক আমার মতোই।
আপনার একাকিত্ব অন্যরকম। আমার অন্যরকম।
আচ্ছা, একটা প্রস্তাব দিলে কি রাগ করবেন?
রাগ করব কেন?
আমাদের বাড়িতে আজ বা কাল একবার আসুন না।
কী হবে এসে? টুপুর ব্যাপারে আমি তো কিছু করতে পারিনি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রমহিলা বললেন, কারওরই কিছু করার নেই বোধহয়। কিন্তু তাতে কী? আমি আপনার একটু সঙ্গ চাই। রাজি হবেন না?
না, রাজি হতে বাধা নেই। আচ্ছা যাবখুন।
ওরকম ভাসা-ভাসা বলা মানেই এড়িয়ে যাওয়া। আপনি কাল বিকেলে আসুন। আমি অপেক্ষা করব।
কখন?
চারটে।
বিকেলে যে আমার অফিস।
কখন ছুটি হয় আপনার?
রাত নটা।
তা হলে সকালে আসুন। এখানেই দুপুরে খেয়ে অফিসে যাবেন।
ধৃতি হেসে ফেলে বলে, চাক্ষুষ পরিচয়ের আগেই একেবারে ভাত খাওয়ার নেমন্তন্ন করে ফেলছেন। আমি কেমন লোক তাও তো জানেন না।
ওপাশে একটু হাসি শোনা গেল। টুপুর মা একটু বেশ তরল স্বরেই বলল,বরং বলুন না যে, আমি আপনার অচেনা বলেই ভয়টা বরং আপনার।
ধৃতি বলে, আমি ভবঘুরে লোক, আত্মীয়হীন, আমার বিশেষ ভয়ের কিছু নেই। পুরুষদের বেলায় বিপদ কম। মহিলাদের কথা আলাদা।
আপনার কিছুই তেমন জানি না বৃটে, চাক্ষুষও দেখিনি, কিন্তু পত্র-পত্রিকায় আপনার ফিচার পড়ে জানি যে আপনি খুব সৎ মানুষ।
ফিচার পড়ে? বাঃ, ফিচার থেকে কিছু বুঝি বোঝা যায়?
যায়। আপনি না বুঝলেও আমি বুঝি। ভুল আমার কমই হয়। আরও একটা কথা বলি। আপনার মতোই আমও কিন্তু একা। আমার কেউ নেই বলতে গেলে। একা থাকি বলেই আমার নিরাপত্তার ভার আমাকেই নিতে হয়েছে। সামান্য কারণে অহেতুক ভয় বা সংকোচ করলে আমার চলে না। এবার বলু আসবেন?
ঠিক আছে, যাব।
সকালেই তো?
খুব সকালে নয়। এগারোটা নাগাদ।
ঠিক আছে। ঠিকানাটা বলছি, টুকে নিন।
ঠিকানা নিয়ে ফোনটা ছেড়ে দেওয়ার পর ধৃতি ভাবতে লাগল কাজটা ঠিক হল কি না, না, ঠিক হল না। তবে এই ভদ্রমহিলা আড়াল থেকে তাকে যৎপরোনাস্তি বিব্রত করে আসছেন কিছুদিন হল। টুপু নামে এক ছায়াময়ীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক পরোক্ষ রহস্য। হয়তো মুখোমুখি ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হলে সেই রহস্যের কুয়াশা খানিকটা কাটবে। তাই ধৃতি এই ঝুঁকিটুকু নিল। বিপদে যদি বা পড়ে তার তেমন ভয়ের কিছু নেই। বিপদ তেমন আছে বলেও মনে হচ্ছে না তার।
একটু অন্যমনস্কতার ভিতর দিয়ে দিনটা কাটল ধৃতির। পত্রিকায় ফিচার লিখলে প্রচুর চিঠি আসে। ধৃতিরও এসেছে। মোট সাতখানা। সেগুলো অন্যদিন যেমন আগ্রহ নিয়ে পড়ে ধৃতি, আজ সেরকম আগ্রহ ছিল না। কয়েকটা খবর লিখল, আড্ডা মারল, চা খেল বারকয়েক, সবই অন্যমনস্কতার মধ্যে। শরীরটাও দুর্বল।
একটু আগেভাগেই অফিস থেকে বেরিয়ে এল ধৃতি। সাড়ে আটটায় ঘরে ফিরে এসে দেখে, পরমা দারুণ সেজে ডাইনিং টেবিলে খাবার গোছাচ্ছে।
কী পরমা? তোমার পতিদেবটি ফিরেছে নাকি?
না তো! হঠাৎ কী দেখে মনে হল?
তোমার সাজ আর ব্যস্ততা দেখে।