ভয় হবে না! কীভাবে পড়ে গিয়েছিলেন! ওরা সব ধরাধরি করে যখন নিয়ে এল তখন তো আমি সেই দৃশ্য দেখে কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার এসে বলে গেল, তেমন ভয়ের কিছু নেই।
ধৃতি একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলল, ভয় পেয়ো না। এরকম জ্বর আমার মাঝে মাঝে হয়।
জ্বর হতেই পারে। কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন কেন?
ধৃতি ফের একটু মুখ টিপে হেসে বলল, ওই মেয়েটাকে দেখেই বোধহয় মাথা ঘুরে গিয়েছিল।
যাঃ! ইয়ারকি হচ্ছে?
কেন, মেয়েটা সুন্দর নয়?
সুন্দর নয় তো বলিনি। তবে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো নয় মোটেই। পৃথাকে আপনি বহুবার দেখেছে।
ধৃতি, আর ইয়ারকি দেওয়ার মতো অবস্থা নয়। সে ক্লান্তিতে চোখ বুজল।
শুনছেন? ডাক্তার আপনাকে গরম দুধবার্লি খাইয়ে দিতে বলে গেছেন।
দুধবার্লি আমি জীবনে খাইনি। ওয়াক।
অসুখ হলে লোকে তবে কী খায়?
ও আমি পারব না।
না খেলে দুর্বল লাগবে না?
পি এম-এর পার্টিতে খেয়েছি। খিদে নেই।
কী খাওয়াল ওখানে?
অনেক কিছু।
পি এম-কে দেখলেন?
দেখলাম।
আপনি ভাগ্যবান। আমাকে দেখালেন না তো? আচ্ছা আপনি ঘুমোন। একটু বাদে তুলে খাওয়াব।
ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে আর ডেকো না পরমা। একটানা কিছুক্ষণ ঘুমোলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
তাই কি হয়? খেতে হবে।
হবেই?
না খেলে দুর্বল হয়ে পড়বেন।
ধৃতি একটু চুপ করে থেকে বলল, ওরা আমাকে চ্যাংদোলা করে ওপরে এনেছিল, না?
প্রায় সেইরকম? কেন বলুন তো।
আমিও বুঝতে পারছি না হঠাৎ একটা সুন্দর মেয়ের সামনে গাড়লের মতো আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম কেন। বিশেষ করে মেয়েটা যখন ওদের ঘরে নিয়ে যাচ্ছিল আমাকে।
পরমা সামান্য হেসে বলে, অজ্ঞান কি কেউ ইচ্ছে করে হয়?
ইচ্ছাশক্তিও এক মস্ত শক্তি। ইচ্ছাশক্তি খাটাতে পারলে আমি কিছুতেই অজ্ঞান হতাম না।
এ নিয়ে এত ভাবছেন কেন? কেউ তো আর কিছু বলেনি।
বলার দরকারও নেই। আমি শুধু ভাবছি আমার ইচ্ছাশক্তি এত কম কেন।
মোটেই কম নয়। আজ আপনার খুব ধকল গেছে। সেইজন্য।
ধৃতি একটু গুম হয়ে থেকে বলে, আচ্ছা কী খাওয়াবে খাইয়ে দাও। শোনো তোমাদের রাত্রে রুটি হয়নি?
হচ্ছে।
তাই দুখানা নিয়ে এসো। সঙ্গে ডাল-ফাল যা হোক কিছু।
শঙ্কিত গলায় পরমা বলে, রুটি খেলে খারাপ হবে না তো?
আরে না। বালিফার্লি আমি কখনও খাই না। দুধও চুমুক দিয়ে খেতে পারি না। রুটিই আনো।
পরমা উঠে গেল।
ধৃতি চেয়ে রইল সিলিং-এর দিকে। বড় আলো নেভানো। ঘরে একটা কমজোরি বালবের টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে মাত্র। ধৃতি চেয়ে রইল। স্মরণকালের মধ্যে সে কখনও অজ্ঞান হয়নি। শরীর শত খারাপ হলেও না। তবে আজ তার এটা কী হল? ভিতরে ভিতরে ক্ষয় হচ্ছে না তো তার? জীবনীশক্তি কমে যাচ্ছে না তো?
নিজেকে নিয়ে ধৃতির চিন্তার শেষ নেই।
পরমা রুটি নিয়ে এল। দুখানার বদলে ছখানা। ডাল, তরকারি, আলুভাজা, মাংস অবধি।
ও বাবা, এ যে ভোজের আয়োজন।
রুটিতে ঘি মাখিয়ে দিয়েছি।
বেশ করেছ। আমার বারোটা তুমিই বাজারে।
ওমা, আমি বারোটা বাজাব কী করে?
জ্বরো রুগিকে কেউ ঘি খাওয়ায়?
রুটি শুকনো কেউ খায়?
ধৃতি একটু হাসল। পরমাকে বুঝিয়ে কিছু লাভ নেই। গ্রে ম্যাটার ওর মাথায় খুবই কম। তবে পরমা মেয়েটা বড় ভাল মানুষ। ধৃতি তাই খেতে শুরু করে দিল। কিন্তু বিস্বাদ মুখে তেমন কিছুই খেয়ে উঠতে পারল না। পরমার অনেক তাগিদ সত্বেও না।
ওষুধ খেয়ে সে ক্লান্তিতে চোখ বুজল এবং ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু জ্বর-যন্ত্রণায় কাতর শরীরে নিপাট নিদ্রি ঘুম হয় না। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ ঘুমের চটকা ভেঙে চোখ চেয়েই সে পিপাসায় ওঃ বলে শব্দ করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কে যেন কাছে এল। একটা সুন্দর গন্ধ পেল ধৃতি। ঘুমজড়ানো চোখে অবাক হয়ে দেখল, পরম।
তুমি! তুমি জেগে আছ কেন?
ওমা! আপনার এত জ্বর আর আমি পড়ে পড়ে ঘুমোব?
ধৃতি ম্লান একটু হেসে বলে, বন্ধুপত্নী, তুমি বড়ই সরলা।
সরলা! হোয়াট ডু ইউ মিন? বোকা নয় তো!
বোকা ছাড়া আর কী বলা যায় বলো তো তোমাকে। একেই তো পর-পুরুষের সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে বসবাস করছে। তার ওপর আবার এক ঘরে এবং এত রাতে।
তাতে কী হয়েছে বলুন তো!
এখনও কিছু হয়নি বটে, তবে হতে কতক্ষণ। কথাটা বাইরে জানাজানি হলে যা একখানা নিন্দে হবে দেখো।
ঠোঁট উলটে পরমা বলে, হোক গে। তা বলে একশো চার জ্বরের একজন রুগিকে একা ঘরে ফেলে রাখতে পারব না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধৃতি বলে, একটু জল দাও।
পরমা জল দেয় এবং ধৃতি শোয়ার পর তার কপালে জলে ভেজা ঠান্ডা করতলটি রেখে নরম স্বরে বলে, ঘুমোন, আমি আরও কিছুক্ষণ আপনার কাছে থাকব।
থাকার দরকার নেই। এবার গিয়ে ঘুমোও।
জ্বরটা আর একটু কমুক। তারপর যাব।
এত ভাবছ কেন বলো তো!
কী জানি কেন, তবে কারও অসুখ করলে আমি খুব নার্ভাস হয়ে পড়ি। আপনাকে তো দেখার কেউ নেই।
ধৃতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ক্কচিৎ কদাচিৎ তারও এ কথাটা মনে হয়। তার বাস্তবিকই কেউ নেই। দাদা দিদি এরা থেকেও অনাত্মীয়। তবে বয়সের গুণে এবং কাজকর্মের মধ্যে থাকার দরুন আত্মীয়হীনতা তাকে তেমন উদ্বিগ্ন করে না। বরং কেউ না থাকায় সে অনেকটাই স্বাধীন। তবু এইরকম অসুখ-বিসুখের সময় বা হঠাৎ ডিপ্রেশন এলে একাকিত্বটা সে বড় টের পায়।
পরমা কপালে একটা জলপটি লাগাল। বলল, মাথাটা একটু ধুয়ে দিতে পারলে হত।