আপনার বুঝি খুব কাজ অফিসে?
কাজ না করলে মাইনে দেবে কেন বলুন?
আজ আপনার কী কাজ?
আজ প্রাইম মিনিস্টারের একটা মিটিং কভার করতে হবে।
ওমা! প্রাইম মিনিস্টার? আপনারা কত ভাগ্যবান! কোথায় মিটিং বলুন তো।
রাজভবন।
ইস, কী দারুণ! আপনি প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলবেন?
বলব হয়তো।
ভয় করবে না?
ভয় কীসের? পিএম নিজেই তো মিটিং ডেকেছেন। আমাদের কথা শুনবার জন্যই।
কী বলবেন?
ঠিক করিনি। কথা জুগিয়ে যাবে।
একটা কথা পি এমকে বলবেন?
কী কথা?
বলবেন এ দেশে মেয়েদের বড় কষ্ট।
উনি নিজেও তো মেয়ে। উনি কি আর ভারতবর্ষের মেয়েদের কথা জানেন না?
জানেন। উনি সব জানে। এ দেশের মেয়েরা ওর মুখ চেয়েই তো বেঁচে আছে। তবু আপনি তো পুরুষ মানুষ, আপনার মুখ থেকে মেয়েদের করে কথা শুনলে উনি খুশি হবেন।
ওঁকে খুশি করা তো আমার উদ্দেশ্য নয়।
টুপুর মা একটু চুপ করে থেকে বলে, তা ঠিক। তবে কী জানেন, ওঁকে খুশি করতে কেউ চায় না, সবাই শুধু ওঁর দোষটাই দেখে। পিএম একজন মহিলা বলেই কি আপনারা পুরুষেরা ওঁকে সহ্য করতে পারেন না?
তা কেন? পি এম মহিলা না পুরুষ সেটা কোনও ফ্যাক্টরই নয়। আমরা দেখব ওঁর কাজ।
আমার মনে হয় পুরুষেরা ওঁকে হিংসে করে।
তা হলে পি এম পুরুষদের ভোটই পেতেন না। আপনি ভুল করছেন। এ দেশের লোকেরা ইন্দিরা গাঁধীকে মায়ের মতোই দেখে।
বলছেন! কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না।
অবিশ্বাসের কিছু নেই। দেশটা একটু দুরে এলেই বুঝতে পারবেন।
তা তবশ্য ঠিক। আমি দেশের কতটুকুই বা দেখেছি! কলকাতা আর এলাহাবাদ। আপনি খুব ঘুরে বেড়ান, না?
খুব না হলেও কিছু ঘুরেছি, আর লোকের সঙ্গেও মিশি। আমি তাদের মনোভাব বুঝতে পারি।
জানেন আমাদের এলাহাবাদের হাইকোর্টেই ওঁর মামলাটা হচ্ছিল, আমরা তখন প্রায়ই কোর্টে যেতাম। কী থ্রিলিং! তারপর উনি যখন হেরে গেলেন, কী মন খারাপ!
হতেই পারে। আপনি খুব ইন্দিরা-ভক্ত।
তা বলতে পারেন। আমি ওঁর ভীষণ ভক্ত। আপনি নন?
আমি! আমার কারও ভক্ত হলে চলে না।
ইন্দিরা এলাহাবাদের মেয়ে জানেন তো! আমাদের বাড়ি থেকে ওঁদের আনন্দ ভবন বেশি দূরেও নয়। ছাদে উঠলে দেখা যায়। আপনি তো গেছেন এলাহাবাদে, তাই না?
হ্যাঁ, তবে খুব ভাল করে শহরা দেখিনি।
এবার গেলে দেখে আসনে। খুব সুন্দর শহর।
আচ্ছা দেখব।
আর একটা কথা।
বলুন।
আপনার বোধহয় দেরি হয়ে যাচ্ছে কাজের।
তেমন কিছু নয়।
বলছিলাম কী, আমাকে দয়া করে পাগল ভাববেন না।
ভেবেছি নাকি?
হয়তো ভেবেছেন। ভাবলেও দোষ দেওয়া যায় না। সেই এলাহাবাদ থেকে মাঝরাতে ট্রাঙ্ককল করা, তারপর মাঝে মাঝেই এইভাবে টেলিফোনে উত্ত্যক্ত করা, তার ওপর টুপুর ঘটনা নিয়ে উটকো দায় গপানো, আমি জানি আমার আচরণ খুব অদ্ভুত হচ্ছে। তবু আমি কিন্তু পাগল নই।
আপনি যা করেছেন তা স্বাভাকি অবস্থায় তো করেননি।
ঠিক তাই। শোকে তাপে অস্থির হয়ে কী করব তা ভেবেই পাচ্ছিলাম না।
আমি আপনাকে পাগল ভাবিনি। কিন্তু আমার একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে। টুপুর বাবা কোথায়?
ওমা! বলিনি আপনাকে?
বলেছিলেন। তবে বোধহয় ভুলে গেছি।
আমার স্বামী বেঁচে থেকেও নেই।
তার মানে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুপুর মা বলে, মানে বুঝে আর কাজ নেই। আমার স্বামী ভাল লোক নন। তবে বড়লোকের ছেলে, তাই তাকে সবই মানিয়ে যায়।
তিনি এখন কোথায়?
যতদূর জানি বম্বেতে। একটি কচি মেয়ের সঙ্গে থাকেন।
তিনি বেঁচে থাকতে আপনি তার সম্পত্তি পেলেন কী করে?
তার সম্পত্তি পেলাম শাশুড়ি সেইরকম বন্দোবস্ত করে রেখে গিয়েছিলেন বলেই। তাছাড়া আমার বাপের বাড়িও খুব ফেলনা ছিল না। সেদিক থেকেও কিছু পেয়েছি।
মাপ করবেন, এসব প্রশ্ন করা বোধহয় ঠিক হল না।
টুপুর মা একটু হাসলেন, আমাকে যে-কোনও প্রশ্নই করতে পারেন। আমার আর অপ্রস্তুত হওয়ার কিছু নেই। শোকে তাপে জ্বালায় আমি এখন কেমন একরকম হয়ে গেছি। আচ্ছা, আজ আর আপনাকে বিরক্ত করব না। ছাড়ছি।
আচ্ছা।
ধৃতি টেলিফোন রেখে দিল। তার ভ্রূ একটু কোঁচকানো। মুখ চিন্তান্বিত।
নিউজ এডিটর ডেসকের সামনে দিয়ে একপাক ঘুরে যাওয়ার সময় সামনে দাঁড়িয়ে বললেন ধৃতি, আজ তো তুমি পি এম-এর রাজভবন মিটিং কভার করবে।
হ্যাঁ।
কোনও পলিটিক্যাল ইস্যু তুলো না কিন্তু। মোটামুটি ইন্টেলেকচুয়ালদের প্রবলেমের ওপর প্রশ্ন করতে পারো। ইমার্জেন্সি নিয়েও কিছু বলতে যেয়ো না।
না, ওসব বলব না।
আমাদের কাগজের ওপর রুলিং পাটি খুব সন্তুষ্ট নয়। টেক-ওভারের কথাও উঠেছিল। সাবধানে এগিয়ে।
ঠিক আছে।
ইয়ং রাইটারদের কাকে কাকে চেনো?
কয়েকজনকে চিনি।
তা হলে তো ভালই। পি এমকে কী জিজ্ঞেস করবে বলে ঠিক করেছ?
ধৃতি মৃদু হেসে বলে, দেখি।
প্রধানমন্ত্রীকে ধৃতির অনেক কথা জিজ্ঞেস করার আছে। যেমন, আপনি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে ভালই করেছে বলে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু সেটা এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচনী মামলায় হেরে যাওয়ার পর করলেন কেন? এতে আপনার ইমেজ নষ্ট হল না? কিংবা বিরোধীরা কোনও রাজ্যে সরকার গড়লেই কেন্দ্র তার পিছনে লাগে কেন? কেনই বা নানা উপায়ে সেই সরকারকে ফেলে দিতে চেষ্টা করে? আপনার কি মনে হয় না যে এতে সেই রাজ্যের ভোটাররা অপমানিত বোধ করতে থাকে এবং ফলে দ্বিগুণ সম্ভাবনা থেকে যায় ফের ওই রাজ্যে বিরোধীদের ক্ষমতায় ফিরে আসার? কিংবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর যখন আপনার ভাবমূর্তি অতি উজ্জ্বল, যখন স্বতসূর্ত ভোটের বন্যায় আপনি অনায়াসে ভেসে যেতে পারতেন তখন বাহাত্তরের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে যে ব্যাপক রিগিং হয় তার কোনও দরকার ছিল কি? আপনি এমনিতেই বিপুল ভোট পেতেন, তবু রিগিং করে এখানকার ভোটারদের অকারণে চটিয়ে দেওয়া কি অদূরদর্শিতার পরিচয় নয়? কিংব আপনি যেমন ব্যক্তিত্বে, ক্ষমতায়, বুদ্ধিতে অতীব উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত মানুষ, আপনার আশেপাশে বা কাছাকাছি তেমন একজনও নেই কেন? আপনার দলের সকলেই কেন আপনারই মুখাপেক্ষী, আপনারই করুণাভিক্ষু? কেন আপনার দলে তৈরি হচ্ছে না পরবর্তী নেতৃবৃন্দের সেকেন্ড লাইন অফ লিডারশিপ?