এই অবধি আমার মোটে চারটে খবর বেরিয়েছে। অথচ পঞ্চাশ-ষাটটা লিখতে হয়েছে।
এরকমই হয়। তবু তো তোমরা ফুল টাইম রিপোর্টার। যারা মফসসলের নিজস্ব সংবাদদাতা তাদের অবস্থা কত করুণ ভেবে দেখো। কুচবিহার বা জলপাইগুড়ি থেকে কত খবর লিখে পাঠাচ্ছে, বছরে বেরোয় একটা কি দুটো।
তা হলে আমাদের কভারেজে পাঠানোই বা কেন?
নেট প্র্যাকটিসটা হয়ে যাচ্ছে। এর পরে যখন পাকাঁপোক্ত হবে, স্কু করতে শিখবে তখন তোমাকে নয়েই হবে টানাটানি। যদি মানসিকতা তৈরি করে নিতে পারে তা হলে জার্নালিজম দারুণ কেরিয়ার।
তা জানি। আর সেইজনই লেগে আছি। আপনি কি আজ পি এম-এর রাজভবনের মিটিং কভার করছেন?
হু। আমি অবশ্য আলাদা ইনভিটেশনও পেয়েছি।
রমেন একটু হেসে বলে, আশ্চর্যের বিষয় হল, আমিও পেয়েছি।
ধৃতি একটু অবাক হয়ে বলে, তুমিও পেয়েছ! বলোনি তো!
চান্স পাইনি। আজ সকালেই লালবাজার থেকে বাড়িতে এসে দিয়ে গেল। আসলে কী জানেন, আমি একসময়ে একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করতাম, কবিতাও লিখতাম, সেই সূত্র ধরে আমাকেও ডেকেছে।
এখন লেখো না?
লিখি। অল্প স্বল্প। গত মাসেই দেশ-এ আমার কবিতা ছিল।
বটে। ধৃতি খুশি হয়ে বলে, মনে পড়েছে। আমি দেশ খুলেই আগে কবিতার পাতা পড়ে ফেলি। রমেন সেন তুমিই তা হলে।
অত অবাক হবেন না। আমার মতো কবি বাংলাদেশে কয়েক হাজার আছে।
তা থাক না। কবি কয়েক হাজার আছে বলেই কি তোমার দাম কমে যাবে?
ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই-এর নিয়ম তো তাই বলে। কবিতার ডিমান্ড নেই, কিন্তু সাপ্লাই অঢেল। প্রাইস ফল করতে বাধ্য।
ইকনমিকসের নিয়ম কি আর্টে প্রযোজ্য?
খানিকটা তো বটেই। কবিতা লিখি বলে কজন আমাকে চেনে?
ধৃতি একটু হেসে বলে, একটা মনের মতো কবিতা লিখে তুমি যে আনন্দ পাও তা অকবিরা কজন পায়?
রমেনের মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হল। উষ্ণ কন্ঠে বলল, কবিতা লিখে আমি সত্যিই আনন্দ পাই। এত আনন্দ বুঝি আর কিছুতে নেই।
তবে! দামটা সেইদিক দিয়ে বিচার কোরো। খ্যাতি বা অর্থ দিয়ে তা মাপাই যায় না। যাক গে, যাচ্ছ তো রাজভবনে?
যাব। বড্ড ভয় করে। কী হবে গিয়ে?
চলেই না। আর কিছু না হোক, রাজভবনের ইন্টিরিয়রটা তো দেখা হবে।
তা বটে। ঠিক আছে, যাব।
কাগজ কলম নিয়ে যেয়ো। যা দেখবে বা শুনবে তার নোট নিয়ে।
আমি নোট নেব কেন? কী হবে? রিপোর্ট তো করবেন আপনি।
তাতে কী? আমি যা মিস করব তুমি হয়তো তা করবে না। দুজনের রিপোর্ট মিলিয়ে নিয়ে করলে জিনিসটা ভাল দাঁড়াবে।
মাথা নেড়ে রমেন বলল, ঠিক আছে।
ডেসক থেকে বিমান হাত উঁচু করে ডাকল, ধৃতি! এই ধৃতি! তোর টেলিফোন।
ধৃতি গিয়ে তাড়াতাড়ি ফোন ধরল, ধৃতি বলছি।
আমি বলছি।
কে বলছেন?
গলা শুনে চিনতে পারছেন না? আমি টুপুর মা।
ধৃতি একটু স্তব্ধ থেকে বলল, আপনি এখনও কলকাতায় আছেন?
মাইথন থেকে ঘুরে এলাম।
সেখানে কোনও খবর পেলেন?
না। কেউ কিছু বলতে চায় না। তবে আমার মনে হয় ওরা সবাই জানে যে টুপু খুন হয়েছিল।
ওরা মানে কারা?
ওখানকার লোকেরা।
কী বলছে তারা?
কিছুই বলছে না, আমি অনেককে টুপুর কথা জিজ্ঞেস করেছি।
শুনুন, আপনি এলাহাবাদে ফিরে যান। এভাবে ঘুরে ঘুরে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।
একেবারে যে পারিনি তা নয়। একজন বুড়ো লোক স্বীকার করেছে যে সে টুপুকে বা টুপুর মতো একটি মেয়েকে দেখেছে।
টুপুর মতো মেয়ে কি আর নেই? ভুলও তো হতে পারে!
পারেই তো। সেইজন্য আমি ফিফটি পারসেন্ট ধরছি। টুপুর ঘাড়ের দিকে বাঁ ধারে একটা জরুল আছে। সেটাই ওর আইডেনটিটি মার্ক। বুড়োটাকে সেই জরুলের কথা বলেছিলাম। সে বলল, হ্যাঁ, ওরকম জরুন সেও মেয়েটির ঘাড়ে দেখেছে। এতটা মিলে যাওয়ার পরও ব্যাপারটা উড়িয়ে দিই কী করে বলুন!
তা বটে।
টুপুর সঙ্গে একজন লোককেও দেখেছে বুড়োটা। খুব দশাসই চেহারা। বিশাল লম্বা। লোকটা নাকি টুপুর সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলছিল।
বুড়োটা কে?
একজন ফুলওয়ালা। টুপু লোকটার কাছ থেকে ফুল কিনেছিল।
ধৃতি একটু ঘামছিল উত্তেজনায়, ভয়ে। কণ্ঠস্বর যতদূর সম্ভব নির্বিকার রেখে সে বলল, ঠিক আছে, শুনে রাখলাম। কিন্তু আমি একজন সামান্য সাব-এডিটর। টুপুর ব্যাপারে আমি আপনাকে কোনও সাহায্যই করতে পারছি না। যা করার পুলিশই করবে।
টেলিফোনে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল। টুপুর মা বলল, এখন তো ইমার্জেন্সি চলছে, তাই পুলিশ খুব এলার্ট। কিন্তু কেন যেন টুপুর ব্যাপারে তারা তেমন ইন্টারেস্ট নিচ্ছে না। এমনকী খুনটা পর্যন্ত বিশ্বাস করছে না।
বিশ্বাস করাটা নির্ভর করে এভিডেন্সের ওপর। আপনি আপনার মেয়ের খুনের কোনও এভিডেন্সই যে দিতে পারছেন না।
মায়ের মন সব টের পায়।
কিন্তু পুলিশ তো আর মা নয়?
ঠিক আছে, আপনাকে আজ আর বিরক্ত করব না। কিন্তু কখনও-সখনও দরকার হলে ফোন করব। বিরক্ত হবেন না তো!
না, বিরক্ত হব কেন?
আমি খবরের কাগজের অফিস কখনও দেখিনি। খুব দেখতে ইচ্ছে করে। একদিন যদি আপনার অফিসে গিয়ে হাজির হই তো দেখাবেন? যদি অসুবিধে না থাকে?
নিশ্চয়ই। কবে আসবেন?
এ যাত্রায় হবে না। এলাহাবাদে আমার অনেক সম্পত্তি। সব পরের ভরসায় ফেলে এসেছি। শিগগিরই ফিরতে হচ্ছে। তবে আমি প্রায়ই কলকাতায় আসি।
বেশ তো, যখন সুবিধে হবে আসবেন।
বিরক্ত হবেন না তো!
না, এতে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। আজ ছাড়ি তা হলে?