টুপু কি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল?
কেন, বলিনি আপমাকে সে কথা?
না।
টুপুর মা একটু হেসে বললেন, ওমা। আমারই ভুল তবে। যা হোক, আজকাল আমার মেমরিটা একদম গেছে। হা, টুপু তো পালিয়েই এসেছিল। টুপু যত সুন্দরী ছিল ততটা শান্ত বা বাধ্য ছিল না। খুব অ্যাডভেঞ্চারাস টাইপ।
ও। তা পালাল কেন?
আমি যা বারণ করতাম তাই করব এই ছিল স্বভাব টুপুর। ও খানিকটা ছেলের মতো মানুষ হয়েছিল তো। সাইকেল, সাঁতার, গাড়ি চালানো, বন্দুক হেড়া সব জানত।
খুব চৌখস মেয়ে তো!
খুব। একস্ট্রা-অর্ডিনারি যাকে বলা যায়।
পালাল কেন তা তো বললেন না।
টুপুর যে বিয়ের ঠিক হয়েছিল!
টুপু বিয়েতে রাজি ছিল না বুঝি?
না। ও বলত আর একটু বয়স হলে সে মাদার টেরেসার আশ্রমে বা সৎসঙ্গ কিংবা রামকৃষ্ণ মিশনে চলে যাবে। সারা জীবন সন্ন্যাসিনী হয়ে থাকবে।
কেন?
ও পুরুষদের পছন্দ করত না। না, কথাটা ভুল বলা হল। আসলে ও কখনও তেমন পুরুষ দেখেনি যাকে সত্যিকারের বন করা যায়। সব পুরুষমানুষকেই ও খুব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। বলত, এদের কাউকে বিয়ে করা যায় না।
কিন্তু পালানোর ব্যাপারটা তো বললেন না?
বলছি। আমরা ওর বিয়ে ঠিক করি একজন ব্রিলিয়ান্ট অ্যামেরিকা ফেরত মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। দারুণ ছেলে। টুপুর আপত্তি আমরা শুনিনি।
কেন?
শুনিনি তার কারণ চট করে এরকম ভাল পাত্র কি পাওয়া যায়, বলুন? যেমন চেহারা তেমনি স্বভাব, দেদার টাকা রোজগার করে, হাই পোজিশনে চাকরি করছে।
তারপর?
আশীর্বাদের আগের দিন টুপু একটা চিঠি লিখে রেখে চলে গেল। কাউকে, এমনকী আমাকে পর্যন্ত জানিয়ে যায়নি।
সঙ্গে কেউ যায়নি?
কী করে বলব?
কলকাতায় গিয়েছিল কী করে জানলেন?
সেখান থেকে আর একটা চিঠি দেয়। তাতে লেখে, আমি খুব ফুর্তিতে আছি। এবার বেড়াতে যাব দার্জিলিং, নেতারহাট, মাইথন, আরও কয়েকটা জায়গার নাম লেখে। সব মনে নেই।
কিন্তু মারা যাওয়ার ব্যাপারটা?
ওঃ হ্যাঁ। মাইথন থেকে ওর শেষ চিঠি। তাতে ও খুব মন খারাপের কথা লিখেছিল। জানিয়েছিল যে কে বা কারা ওর পিছু নিয়েছে। তারা ওর ভাল করতে চায় না, ক্ষতি করতে চায়।
তারপর?
তারপর আর কোনও খবর নেই। তবে আমি এক রাতে স্বপ্ন দেখি যে টুপু উঁচু থেকে জলের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। আপনি কখনও মাইথনে গেছেন?
গেছি।
আমি যাইনি। জায়গাটা কেমন?
সুন্দর।
সেখানে পাহাড় আছে?
আছে। তবে ছোট পাহাড়।
টুপুও তাই লিখেছিল। সেখানে কী একটা বিখ্যাত মন্দির আছে না?
আছে। কল্যাণেশ্বরীর মন্দির।
সেখানে সেই মন্দিরে ঢোকার গলিতে নাকি কারা টুপুর পাশ দিয়ে যেতে যেতে শাসিয়েছিল যে মেরে ফেলবে।
কিন্তু কেন?
সে তো জানি না। টুপুর মতো মেয়ের কি শত্রু থাকতে পারে? তবু ছিল, জানেন। আর টুপু যে খুব অ্যাডভেঞ্চারাস টাইপের ছিল।
বুঝলাম। কিন্তু টুপুর সঙ্গে কেউ ছিল না?
হয়তো ছিল। তাদের কথা টুপু লিখত না।
কলকাতায় আপনাদের আত্মীয়স্বজন নেই?
আমার শ্বশুরবাড়ি এখানে। তবে আমার দিককার কোনও আত্মীয় এদিকে থাকে না। আমার বাপের বাড়ি গোরক্ষপুরে, তিন পুরুষের বাস।
টুপু কি তার বাপের বাড়িতে উঠেছিল?
টুপুর মা হেসে বললেন, টুপুর বাপের বাড়ি বলতে অবশ্য এলাহাবাদের বাড়িই বোঝায়। তবে এখানে আমার স্বামীর খুড়তুতো ভাই-টাই আছেন। বাড়ির একটা অংশ অবশ্য আমাদের। সে অংশ তালা দেওয়া থাকে, আমরা কলকাতায় এলে সেখানেই উঠি। কিন্তু টুপু এ বাড়িতে আসেনি।
ধৃতি এতক্ষণ পরে টের পেল যে, সে খামোখা এত কথা বলছে বা শুনছে। শুনে তার কোনও লাভ নেই। টুপুর ব্যাপারে তার করারও কিছু নেই।
ধৃতি বলল, সবই বুঝলাম। কিন্তু সিমপ্যাথি জানানো ছাড়া আর কী করতে পারি বলুন?
শুনুন। দয়া করে আপনার বাসার ঠিকানাটা দেকেন?
কেন?
বিরক্ত হবেন না। ঠিকানাটা থাকলে আমি যদি দরকারে পড়ি তাহলে কন্ট্যাক্ট করতে পারব। আমি কলকাতার কিছুই চিনি না। আমার দেওররাও খুব সিমশাথেটিক নয়। আমি আপনার মতো একজন বুদ্ধিমান লোকের সাহায্য পেলে খুব উপকৃত হব। অবশ্য যদি কখনও দরকার হয়। নইলে এমনিতে বিরক্ত করব না।
একটু দ্বিধা করেও ধৃতি ঠিকানা বলল।
আপনার বাসায় ফোন নেই?
না।
আচ্ছা, ছাড়ছি।
ভদ্রমহিলা ফোন রাখলেন। ধৃতি হাফ হাড়ল।
৫. পার্ক স্ট্রিটের রেস্টুরেন্টে
০৫.
পার্ক স্ট্রিটের একটা বড় রেস্টুরেন্টে দামি ডিনার খেল ধৃতি। মাঝে মাঝে খায়। বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরল। যতদিন এরকম একা আছে ততদিন আমিরি করে নিতে পারবে।
বিয়ে ধৃতি করতে চায় না। কিন্তু বউয়ের কথা ভাবতে তার খারাপ লাগে না। কিন্তু ভয় পায়। সে একটু প্রাচীনপী। আজকালকার মেয়েদের হাব-ভাব আর চলাফেরা দেখে তার ভয় লাগে। এরা তো ঠিক বউ হতে পারবে না। বড়জোর কম্প্যানিয়ন হতে পারে, আর বেড-ফ্রেন্ড।
ট্যাক্সি ছেড়ে ধৃতিফ্ল্যাটে উঠে এল। দরজা ভাল করে বন্ধ করল। নিজের ঘরে এসে জামাকাপড় ছেড়ে টেবিলের সামনে বসে সিগারেট ধরাল। এখন রাত পর্যন্ত সে জেগে থাকবে। কয়েকটা থ্রিলার কেনা আছে। পড়বে। তার আগে একটু কিছু লিখবে। এই একা নিশুত রাতে জেগে থাকা তার বড় প্রিয়। এইটুকু একেবারে তার নিজস্ব সময়।
শৌখিন রিভলতি চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে হঠাৎ মনে পড়ে চিঠির বাক্সটা দেখে আসেনি।