বুড়ি তটস্থ হয় বটে, তবে হার মানে না। বলে, না খেয়ে মরছে দু চোখে দেখে থাকি কী করে বল? তোর তো ভাসাভাসি, না হয় দিলামই একটু খুদ কুঁড়ো।
তা দিতে হলে বলেই তো নিতে পারো। চুরি করে দাও কেন?
আহা, চুরি হতে যাবে কেন, আমার কি হক নেই! তুই পেটের মেয়ে নোস?
বিয়ে হলে মেয়ে পর হয়ে যায়, এ তুমি জানো না? খেয়ে পরে আছ, সেই ঢের। বেশি বায়নাক্কা দেখলে কিন্তু অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
শুনে মরে যাই, বলি মানুষের মতো কি রেখেছিস? গুদোমঘরটায় ইঁদুর বেড়ালের মতো পড়ে আছি, ও কি থাকা হল? ওদিকে দালানকোটার ঘরগুলো তো হা-হা করছে, দরদ থাকলে না হয় দিতি একখানা ভাল ঘর। পাঁচজনে দেখে যে মুখে থুথু দিচ্ছে তোর। বড় মুখ করে আবার বলতে এয়েছে, খাওয়া-পরা দিচ্ছে। কুকুর-বেড়ালকেও লোকে দেয়, বুঝলি? অত বড়াই করতে হবে না, তোরটাই কি থাকবে ভেবেছিস? উড়ে পুড়ে আংড়া হবে একদিন, দেখিস, মেগে-পেতে খাবি।
শুনে বড় ভয় পেয়ে যায় বাসন্তী। মা তো নয়, ডাইনি, কোনও কথা মুখে আটকায় না। শাপশাপান্তকে বড্ড ভয় তার। যদি ফলে যায়! তাই আর কথা বাড়ায় না সে।
কিন্তু মুক্তার ওসব ভয়-টয় নেই। সে প্রায়ই ঝেড়ে কাপড় পরায় মাকে। এখনও তার ঝনঝনে গলা আসছিল উঠোন থেকে। তুমুল হচ্ছে দুজনে।
মায়ের জন্য রসিক ভাল ব্যবস্থাই করতে চেয়েছিল। মরণের পড়ার ঘরের পাশের ঘরখানা। দিব্যি বড়-সড় আলো-হাওয়ার ঘর। কিন্তু বাসন্তীই রাজি হয়নি। বলেছিল, ভাল ঘরদোর পেলে পেয়ে বসবে, আর কখনও ফিরে যেতে চাইবে না। আর মায়ের মন তো জানি, চোরাপথে ছেলেদেরও আনাগোনা শুরু হবে। জেনেশুনে ঘরে খাল কেটে কুমির আনতে পারব না। আতান্তরে পড়েছে, দুদিন ওই লাকড়ির ঘরেই থাক। নইলে পেয়ে বসবে।
কথাটা খুব মিথ্যেও বলেনি বাসন্তী। সে জানে তার দাদারা ওত পেতেই আছে। সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
অশান্তি আর ভাল লাগে না বাসন্তীর। একে সে মরছে নিজের মনের হাজারো জ্বালায়।
সে বারান্দায় এসে দেখল, মা উঠোনের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে। আঁচলের আবডালে একটা ছোট ধামা গোছের কিছু। আর এদিকে মুক্তা, তার হাতে উঠোন পরিষ্কার করার বঁটাখানা, সেইটে আস্ফালন করেই সে বলছিল, আর কত এ-বাড়ির সর্বনাশ করবে ঠাকরোন? তোমার চেয়ে কালসাপও ভাল।
মা ঊর্ধ্বমুখ হয়ে তার দিকে চেয়ে বলল, শুনলি লা আস্পদ্দার কথা!
বাসন্তী মুক্তাকে একটা ধমক দিল, চুপ কর তো মুক্তা। আর চেঁচামেচি ভাল লাগছে না।
মুক্তা ওপর দিকে চেয়ে বলল, যদি দানছত্তর খুলে থাকো তাহলে বলার কিছু নেই, এ-বাড়ির ভালমন্দের সঙ্গে জুড়ে আছি বলে বলি, নইলে আমার কী? গতকালও আড়াই কেজি গম গেছে ও বাড়িতে। এই দেখ, আবার কী যায়। পটলি ছুঁড়িটাকে তো দেখলুম ওই হোথা কচুবনের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে আছে শেয়ালের মতো। নিত্যি আসে। বলি, বাবুর ভিটেতে কি ঘুঘু চড়াবে শেষ অবধি? দুধ-কল্লা দিয়ে কালসাপ পোষা বই তো নয়।
বড় হতাশ লাগে বাসন্তীর। কথা না বাড়িয়ে সে ঘরে চলে এল, যা হচ্ছে হোক, সে আর ওসবের মধ্যে থাকবে না।
আবার মনে হয়, সে কী কথা! কত বিশ্বাস করে, কত নির্ভরতায় নিজের রক্ত জল করা বিষয় সম্পত্তি তার হাতে দিয়ে বসে আছে লোকটা। বাসন্তীর কি দায় নেই? সে কি পারে সব উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে? এসব রক্ষে করার জন্যই না সে বহাল আছে এখানে।
বিকেলে সে গিয়ে শান্তভাবেই মাকে বলল, অনেকদিন তো হল মা, এবার বরং বাড়ি যাও।
তাড়িয়ে দিচ্ছিস নাকি লা?
মেয়ের বাড়িতে থাকা কি ভাল? খারাপ দেখাচ্ছে না?
সে আগেকার দিনে বড় বড় বাড়িতে ওসব মানত। আমাদের মতো হাঘরেদের আবার নিয়ম কী লা? কেন, জামাই কিছু বলেছে?
সে বলার মতো লোক নয়, তুমিও তা জানো। মিথ্যে কথা বলব কেন মা, আমারই ব্যাপারটা ভাল লাগছে না।
হারে, আমি তোর সৎমা?
তাই কি বললুম! বরং তোমাকে মাসে মাসে কিছু থোক দেবোখন, যদিও তোমার ছেলেরা টের পেলে কেড়ে নেবে। তবু বলি আলগা থাকাই ভাল।
বুঝেছি বাপু, বুঝেছি। তোর সুখের সংসারে আমার শ্বাসটুকুও তোর সহ্য হয় না, কী চোখেই যে দেখলি আমাকে কে জানে! তা তোর আর দোষ কী? তুই কি আর সেই বাসন্তী আছিস? মন্তর করে তোর মাথাটাই খেয়ে রেখেছে বাঙাল। নইলে নিজের গর্ভধারিণী মাকে এমন অচ্ছেদ্দা কেউ করে?
বলে মা কাঁদতে বসল, বাসন্তী জানে, কান্নাটা ও মানুষের মধ্যেই আছে। চোখে জল এনে ফেলতে দেরি হয় না।
খুব ক্লান্ত গলায় বাসন্তী বলল, সে তুমি যা ভাল বোঝো ভেবে নিও, কিন্তু বাড়ি ফিরে যাও। শত হলেও সেটা তোমার স্বামীর ভিটে। জামাইয়ের বাড়িতে থাকলে লোকে দুয়ো দেবে।
বাসন্তী চলে এল নিজের ঘরে। মন ভাল নেই। সংসারের এইসব তুচ্ছ, সংকীর্ণ ব্যাপার তার আর ভাল লাগে না। মনটা বড় ক্ষ্যাপা হয়ে আছে।
আজ শুক্রবার। শনিবার তার মন ভাল হয়। তার বর আসে। দুটো দিন তার মন ভরে থাকে।
এবার এলে সে বরের কাছে সব বলবে। সব মনের কথা, ভয়ের কথা, মন খারাপের কথা। বলে বলবে, আমার কী হবে বলে দাও। আমি কি সত্যিই তোমার কেউ হই?
কই গেলা গো?
ভীষণ চমকে গেল বাসন্তী। কার গলা! আজ তো তার আসার কথা নয়।
দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে দেখল, রসিক দুটো মস্ত ব্যাগ বারান্দায় নামিয়ে রাখছে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নেমে আসছিল বাসন্তী। রসিক কাণ্ড দেখে চেঁচিয়ে উঠল, আরে কর কি পোয়াতি মানুষ? পিছলাইয়া পড়বা নাকি?