তুমি শুধু সন্তানের কথা ভেবে বলছ?
বিয়ের উদ্দেশ্যই তো সন্তান। তার জন্যই শরীর লাগে, মনও লাগে। কোনওটাই তুচ্ছ নয়। সন্তান মানে সমতান। একদিন আমাদের জৈব প্রয়োজন শেষ হয়, আয়ু ফুরোয়, তখন ওই সন্তানের ভিতর দিয়ে আবার আমরাই বেঁচে থাকি।
জ্যোতিপ্রকাশ একটু প্রাচীনপন্থী, একটু গোঁড়াও হয়তো। আর কেন যেন সেই কারণেই লোকটার ওপর নির্ভর করতে ভরসা পায় পারুল।
নিজের রূপ নিয়ে বিয়ের পরও ঝামেলা কিছু কম হয়নি। জান সিং এক মস্ত খদ্দের তাদের। লম্বা-চওড়া আখাম্বা চেহারার রূপবান পুরুষ। কিছু তরলমতি এবং ফুর্তিবাজ। লোকটা জান-কবুল প্রেমে পড়ে গিয়েছিল পারুলের। কাণ্ডজ্ঞানরহিত অবস্থায় সে একদিন অফিসঘরে একলা পেয়ে পারুলের হাত চেপে ধরে বলল, আমার অনেক টাকা আছে। দিল্লি আর হরিয়ানায় আমার অনেক সম্পত্তি। চলো আমার সঙ্গে।
পারুল সেই শক্তিমান পুরুষটির দিকে চেয়ে ফের অমল রায়কেই দেখতে পেয়েছিল। সে খাদ্য, পুরুষেরা খাদক। সে মিষ্টি ও কঠিন করে বলেছিল, আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি একটা কিছু গড়ে তোলার জন্য। মানুষ সবসময়েই কিছু গড়ে তুলতে চায়। আবহমানকাল ধরে মানুষের সেই চেষ্টা। তুমি সব ভেঙে দিতে চাও? ছক উলটে দেবে? মিসমার হয়ে যাবে সব? তুমি আমাদের মস্ত ক্লায়েন্ট সিং সাহেব, কিন্তু তোমাকে ছাড়াও আমাদের চলে যাবে।
জান সিং বার্তা পেয়ে গেল। কিন্তু হাত ছেড়ে দিয়ে সে বলেছিল, দেয়ার ইজ সামথিং উই কল লাভ। আই অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ। সেই প্রেমটাকে একটা সম্মান তো দেবে?
আমার ভালবাসা শুধু পুরুষমানুষ নিয়ে তো নয়। আমি এবং আমার স্বামী উই শেয়ার বেড, বিজনেস, বিয়ারিংস। আমাদের ভালবাসা হুট করে হয়নি, ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। হুট করে তা ভেঙেও যাবে না। আমি দমকা প্রেমে বিশ্বাস করি না।
ডু ইউ অ্যাডোর মি?
না সিং সাহেব, আই ডোন্ট অ্যাডোর ইউ। ইউ আর এ বিগ অ্যান্ড উইক ম্যান।
একটা মেয়েই জানে কতরকম লড়াই একটা মেয়েকে গোপনে এবং একা করে যেতে হয়। প্রত্যাখ্যানের পর প্রতিশোধের পালাও শুরু হয় কখনও কখনও। বদনাম ছড়ানো, মুখে অ্যাসিড মারা, খুন অবধি। জান সিং বহু টাকার অর্ডার ক্যানসেল করল, গুণ্ডা লাগিয়ে কারখানায় গোলমাল পাকাল। খুব অশান্তি গিয়েছিল কয়েক দিন।
জান সিং একাই তো নয়। কেউ গভীরভাবে তার প্রেমে পড়েছে, কেউ হালকা ফুর্তি লুটে নিয়ে যেতে চেয়েছে, কেউ নানা সুবিধে করে দেওয়ার টোপ ফেলেছে, কেউ নিজেকে ময়ূরের মতো সাজিয়ে জাহির করেছে। আর ট্রেনে বাসে গায়ে অঙ্গ স্পর্শ করানো তো আছেই। খদ্দের সবাই। প্রায় সবাই। সারি সারি মুখ মনে পড়ে যায় তার। নির্লিপ্ত মানুষও কি নেই? ঢের আছে। তাই সব পুরুষকে সে ঘেন্না করে না, বেছে বেছে করে। মুখচোখ দেখেই তার মেয়েলি অ্যান্টেনায় পুরুষের তরঙ্গ ঠিক ধরা পড়ে।
তবু অমল রায়ের প্রতি তার কেন কৌতূহল? কেন এখনও? নিজেকে এই প্রশ্নের ছোবলে ছোবলে অস্থির করে তুলে সে খুব আনমনে টর্চের আলো ফেলে ফেলে বড় উঠোনটা পার হচ্ছিল।
পিছন থেকে সন্ধ্যা বলল, আবার আসিস পারুলদি।
পারুল কথাটা শুনতেই পেল না। উঠোন পেরিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা, দুধারে গাছপালার ডালপাতা গায়ে লাগছিল তার। আচমকাই কামিনী ঝোপটার পাশে টর্চের আলোয় মেয়েটাকে দেখতে পেল সে।
পরনে হলুদ রঙের কুর্তা সালোয়ার।
থমকে দাঁড়াল পারুল। মেয়েটা এখানে কী করছে?
পারুল হয়তো কথা না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেত। কিন্তু মেয়েটাই হঠাৎ পরিষ্কার বাংলায় বলল, আপনি পারুল না?
“পারুল” শুনে ভ্রূ কোঁচকাল পারুল। পিসি বা মাসি বা দিদি নয়, শুধু পারুল! অবশ্য ওরা বিদেশে ছিল, সেখানে এরকমই রেওয়াজ।
পারুল রাগ না করে স্নিগ্ধ গলাতেই বলল, হ্যাঁ। তুমি আমাকে চিনলে কী করে?
আমি সোহাগ, অমল রায়ের মেয়ে। আমাদের অ্যালবামে আপনার একটা ছবি আছে।
আমার ছবি! আশ্চর্য!
মাই ড্যাড অ্যাডোর্স ইউ।
ঝম করে লজ্জার একটা ঝাপটা লাগল তার মুখে। পারুল বলল, তাই নাকি? হতে পারে। আমরা তো এক গাঁয়েরই মানুষ।
আপনার যে ছবিটা আমাদের অ্যালবামে আছে সেটা অনেক কম বয়সের। বোধ হয় সতেরো আঠেরো।
উদাস গলায় পারুল বলে, তা হবে।
ইউ আর এ ভেরি বিউটিফুল উওম্যান।
তুমিও তো সুন্দর।
মে বি। কিন্তু বাবা বলে আপনার মতো নাকি বাবা আর কাউকে দেখেনি।
অমলদা এসব বলেছে বুঝি তোমাদের।
হ্যাঁ। আমাদের মধ্যে খুব ফ্র্যাঙ্ক আর ট্রুথফুল কথা হয়।
তাই বুঝি!
আপনার যে বয়সের ছবিটা আমাদের অ্যালবামে আছে বোধহয় সেই বয়সেই ইউ ওয়্যার ডি-ফ্লাওয়ারড বাই মাই ড্যাড।
পারুলের শরীর সিঁটিয়ে গেল লজ্জায়। বুকের ভিতরটা ঝমঝম করছে রাগে। তারপর ফণা তুলল।
তোমরা বুঝি এতটাই ফ্র্যাঙ্ক?
অ্যান্ড হোয়াই নট?
তোমার বাবা একটা শিক্ষিত গাধা। একে ফ্র্যাঙ্কনেস বলে না, একে বলে ফুলিশনেস।
মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে একমত হয়ে বলে, হি ইজ অফকোর্স অ্যান ইডিয়ট।
রাগে ফুঁসছিল পারুল। মেয়েটাকে একটা থাপ্পড় মারার প্রবল ইচ্ছে যে কী করে সে দমন করল কে জানে।
আর ইউ ক্রস উইথ মি পারুল?
ইয়েস আই অ্যাম ক্রস উইথ ইউ।
হোয়াই কান্ট ইউ টেক এ ট্রুথ অ্যাজ এ ট্রুথ? তা ছাড়া বাবা প্রথম কথাটা আমাদের কাছে বলে ফেলে আফটার এ ফিউ রাউন্ডস অফ হুইস্কি। আমি আর মা বসে অ্যালবামটা দেখছিলাম, তখন। পরে যখন আমরা বাবাকে চেপে ধরি তখন সোবার অবস্থাতে বাবা স্বীকার করেছিল। নো হার্ড ফিলিং পারুল। আই অ্যাম সরি।