তারপর একদিন হয়তো সে ইরফানের কাছে সোজা গিয়ে বলবে, আমি পাকিস্তানে চলে যাব। আমাকে সীমানা পার করে দাও।
কিংবা সে হয়তো ঘুরে ঘুরে কষ্টেসৃষ্টে জোগাড় করার চেষ্টা করবে সতেরোটা ঘুমের বড়ি যা হাতে নিলে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া যায়, বালিশের পাশে নিয়ে শুলে কেটে যায় ভয় কিংবা ভবিষ্যৎ-চিন্তা।
কী করবে তা ঠিক জানে না শ্যাম। কেবল মনে হয়, এখনই হয়তো সবচেয়ে সুসময়।
আজও লীলা কাচের দরজার সামনে এসে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। দ্বিধা! কিংবা অপেক্ষা! তারপর শ্যামকে আপাদমস্তক চমকে দিয়ে দরজা খুলে লীলা রাস্তায় নেমে এল। একা। ধীর পায়ে হেঁটে যেতে লাগল।
প্রথমে কিছুক্ষণ এটা বিশ্বাস করল না শ্যাম। তারপর বুঝল মেয়েটা লীলাই, এবং সে একা হেঁটে যাচ্ছে। ধীর পায়ে।
নিঃশব্দে শ্যাম তার থামে হেলানো শরীব তুলে আনল। তার শরীর কাঁপতে থাকে, নানা রহস্যময় অনুভূতি তার ভিতরে খেলা করে যায়। তার খুব জোরে হেসে উঠতে ইচ্ছে করে, হাঁটু গেড়ে বসে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে। তুমি লীলা! তুমি কি লীলা! আমার সঙ্গে এক সমতলে তুমি হেঁটে যাচ্ছ। একা।
নিঃশব্দে বেড়ালের মতো পায়ে, গোয়েন্দার মতো সন্ধানী চোখে লীলাকে রেখে, ভিড়ের ভিতরে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে শ্যাম হাঁটে। হেঁটে যায়।
গাঢ় বাদামি জমির ওপর ফ্যাকাশে কলকা এবং আরও নানা জ্যামিতিক ছাপ দেওয়া একটা শাড়ি পরেছে লীলা, মোটা একটা বেণিতে বাঁধা তার চুল। পিছন থেকেও লীলাকে বড় পবিত্র দেখাচ্ছে। অলস মন্থরভাবে সে হাঁটছে, বাঁ হাতটা বুকের ওপর গোটানোবোধ হয় সে তার সাদা ব্যাগটা বুকে চেপে ধরে আছে, গলায় জড়ানো কাশ্মীরি স্কার্ফের আঁচল উড়ছে হাওয়ায়।
রাস্তায় ভিড়, তবু ভিড়টাকে যথেষ্ট বলে মনে হয় না শ্যামের। তার এবং লীলার মধ্যে অনেকটা শূন্য জমি। লীলা ঘাড় ঘোরালেই চোখাচোখি হয়ে যেতে পারে। তার শুন্য বুকের ভিতরে লাফিয়ে ছুটছে হরিণ, শরীরের ভিতরে রহস্যময় মেঘ ডেকে ওঠে, বৃষ্টি নামে, কালো একটা রেলগাড়ি খুব লম্বা একটা পুল পেরোতে থাকে। যদি চোখাচোখি হয়—যদি চোখাচোখি হয়ে যায়। যদি কথা বলে লীলা! যদি প্রশ্ন করে, তুমি কে?
ভাবতেই জড়িয়ে আসে শ্যামের হাত-পা। খালি রাস্তায় সে হোঁচট খায়। হাসে। আবার হাঁটে। তা হলে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে যাবে, অদৃশ্য থেকে নেমে আসবে এক ঢল জলের প্লাবন, হয়তো বা কথা বলে উঠবে রাস্তাঘাট! আর তখন নিশ্চিত নিজের পরিচয় ভুলে যাবে শ্যাম, লীলার সামনে দাঁড়িয়ে পাঠ-ভুলে-যাওয়া বাচ্চা ছেলের মতো ভীত চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। বিড় বিড় করে বলবে—প্রশ্ন কোরো না আমি কে। আমি জানি না।
সামনের মোড়ে রাস্তা পার হওয়ার অপেক্ষায় ভিড় জমে আছে। পুলিশের উত্তোলিত হাত চলন্ত গাড়িগুলো আটকে দিল। লীলা সামান্য থেমে আবার হাঁটে। রাস্তা পার হয়। ধীর মন্থর তার গতি কোনওখানে যাওয়ার তাড়া বা লক্ষ্য নেই তার। চারধারে অর্থহীন অলীক ছায়ার মতো লোকজন। শ্যাম এদের কাউকেই চেনে না, জানে না এরা বাস্তবিক আছে কি না। এরাও কি তা জানে! শ্যাম এইসব ছায়া ভেদ করে হেঁটে যায়। বাসস্টপ থেকে কারা যেন লীলাকে উদ্দেশ করে বলে, বাঃ বেশ। অমনি গরগর করে ওঠে শ্যাম, অন্ধের মতো রুখে ঘুরে দাঁড়ায়, ফিস ফিস করে চাপা হিংস্র গলায় বলে, সাবধান! আমি পাহারায় আছি। হাসে। আবার হাঁটতে থাকে। নিজেকে বড় জীবন্ত মনে হয় তার। শরীরের ভিতরে কলকারখানা চলার আওয়াজ। সুসময়…পৃথিবীতে এটাই বোধহয় সবচেয়ে সুসময় যা শ্যাম পেরিয়ে যাচ্ছে।
লীলার গতি ক্রমে আরও মন্থর হয়ে আসে। সে অন্যমনে ফুটপাথের আরও ধার ঘেঁষে যায়, মুখ ফিরিয়ে শো-কেসের জিনিস দেখতে দেখতে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে যায়, মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখে, তারপর পা পা করে হাঁটতে থাকে। লীলাকে যতটা অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে ততটা সে নয়— শ্যাম জানে। লীলার শরীর সতর্ক, কান উদগ্রীব সে জানে যে, শ্যাম তার পিছনে আছে। খোলামেলা রাস্তায় একা অরক্ষিত লীলা। কে জানে লীলা তাকে নিঃশব্দে বলছে কিনা-কাছে এসো। ভাল করে দেখতে দাও তোমার মুখ। তোমরা কি হিন্দু? তোমরা কী গোত্র? তোমার নাম পরিচয় আমাকে বলো। তোমার বাড়ি-ঘরদোরের অবস্থা আমাকে বলো। তোমরা ক’ ভাইবোন? আর তোমার চাকরি…?
এ-সবকিছুই খুব জরুরি প্রশ্ন। লীলার জানা দরকার। শ্যাম তাই মনে মনে উত্তর দিয়ে দেয়—শ্যাম চক্রবর্তী আমার নাম, বাবা কমলাক্ষ চক্রবর্তী আমরা শাণ্ডিল্য গোত্র, বিক্রমপুরের বানিখাড়া গ্রামে আমাদের বাড়ি…না আমার ভাই নেই, এক বোন, মুর্শিদাবাদে তার বিয়ে হয়েছিল, তারপর আর খবর জানি না…সেইন্ট অ্যান্ড মিলারে আমি ছিলাম ছোটসাহেব, ওপরওয়ালা বাস্টার্ড বলে গাল দেওয়ায় আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম…তবু সত্যি বলতে কী আমি জানি না আমি কে কিংবা আমি কীরকম…
লীলা আস্তে আস্তে হাঁটে, যে-কোনও দোকানের সামনে একটু দাঁড়ায়, শো-কেস দেখে নেয়, আবার হেঁটে যায়। সাহসী লোকেরা তার কাছ ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছে।
ক্রমে লিন্ডসে স্ট্রিটের কাছে চলে এল তারা। রাস্তা ক্রমে ফঁাকা হয়ে আসছে। রাস্তা পার হওয়ার আগে লীলা একবার ফিরে তাকায় অন্যমনে। অবহেলার চোখ তাচ্ছিল্য ফুটে আছে। পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নেয়। তবু বঁড়শির মতো সেই দুটি চোখ শ্যামের বুকের মধ্যে গেঁথে যায়। তার শরীর যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে। বুকের মধ্যে হঠাৎ জলোচ্ছ্বাস ফুলে ফেঁপে ওঠে। তার শ্বাসকষ্ট হতে থাকে।