আর তার একটু অনিশ্চিত চোখ আর নগ্ন দুটি হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্লান্তিহীন টেলিফোনের চাবি থেকে নোট-বই, খোলা কাগজ এবং আবার টেলিফোনে। দু’টি কাজের হাত তার স্বয়ংক্রিয়। তবু শ্যাম দেখে, যেন পিয়ানোর চাবি ছুঁয়ে যাচ্ছে।
শ্যামের আশেপাশে যারা বসে ছিল, তারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও কাজে এসেছে, তাই একটু পরে পরে প্রত্যেকেরই ডাক এল। ভিতর থেকে, এবং এইভাবে আস্তে আস্তে তার আশপাশ খালি হয়ে গেল। একসময়ে দেখল *ম যে, সে একা বসে আছে। আর রিসেপশনের মেয়েটি তার অত ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝে মাঝে তাকে লক্ষ করছে।
খুব অবাক হয়ে শ্যাম টের পায়, তার বুকের মধ্যে রেলগাড়ির সেই স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার শব্দ–ধীর থেকে দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। সামান্য তেষ্টা পাচ্ছিল তার। পকেটে হাত দিয়ে দেখল সিগারেট নেই। কাচের দরজা ঠেলে দু’টি চটপটে মার্কিন ভদ্রলোক ঘরে আসে, কাউন্টারের সামনে দাঁড়ায়, নিচু স্বরে কী একটু রসিকতা করে। মেয়েটি হেসে তার সপ্রতিভ চোখেমুখে জবাব দিয়ে দেয়। আবার শূন্য হয়ে যায় ঘর। কিছু একটা লিখে রাখতে গিয়ে কোনও ভুল ধরা পড়ায় মেয়েটি জিভ কেটে পরিষ্কার বাংলায় বলে এঃ মা! চকিতে একপলক শ্যামকে লক্ষ করে চোখ নামিয়ে নেয়। টেলিফোন শব্দ করে উঠলে অবলীলায় টেলিফোন তুলে নিয়ে তুখোড় ইংরিজিতে বলে ও, বোস…মিস্টার বোস!…ইয়েস মিস্টার বোস…হিয়ার হি ইজ… থ্যাঙ্ক ইউ। আবার চকিতে চোখাচোখি হয়ে যায়।
আস্তে আস্তে অস্বস্তি পেয়ে বসে শ্যামকে। সে এই প্রথম টের পায় অনেক দিন হয়ে গেল সে আর নিজেকে সাজায় না। অযত্নের বাগানের মতো বন্য হয়ে গেছে তার শরীর, পুরনো পুথিপত্রের মতো ঝুরঝরে হয়ে গেছে চোখের চাউনি। এন্ডির চাদরের তলায় তার স্খলিত হাত আর পেট থেকে বুক পর্যন্ত সন্তর্পণে নিজেকে পরীক্ষা করে দেখে না, কোনওখানে নেই সেই পুরনো শ্যাম। বস্তুত তার মনে হয় এই-যে লোকটা সে–এন্ডির চাদর গায়ে গালে দাড়ি, ভিতরে অস্থির এক রেলগাড়ির পুল পেরিয়ে যাওয়ার গুম গুম শব্দ একে কোনওকালে কখনও চিনত না শ্যাম। ওই মেয়েটির সামনে ধরা-পড়া অসহায় এক অচেনা লোক বসে আছে।
কী ভাবছ তুমি? আমি বাইরের দুপুরের রোদ এড়াতে কৌশলে তোমাদের এই ঠান্ডা সুন্দর ঘরে ঢুকে বে-আইনিভাবে বসে আছি? কিংবা আমি বদমাশ, তোমাকে সুন্দর দেখে তোমার মুখোমুখি বসে আছি, সময়মতো হয়তো বা পিছু নেব? কিংবা আমি যে চোর-জোচ্চোর মতলববাজ নই, সে-সম্বন্ধে তুমি নিশ্চিত হতে পারছ না? শ্যাম মনে মনে এইসব কথা বলে মেয়েটিকে। যেন বা একা একটি ঘরে সুন্দরী মেয়েটির মুখোমুখি তাকে বসিয়ে রেখে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।
সে সহ্য করতে পারে না। সামনের টেবিলে রাখা এক তূপ পত্রপত্রিকা থেকে একটা ছবির কাগজ তুলে নিয়ে তার ওপর মুখ নিচু করে রাখে। সিগারেট নেই–সেকথা ভুলে গিয়ে পকেটের দিকে হাত বাড়াতেই চটাস করে শব্দে হাত পা কেঁপে ওঠে তার।
এইসব ছোটখাটো অথচ গুরুতর ঘটনা ঘটে যেতে থাকলে শ্যাম প্রাণপণে চেষ্টা করে মেয়েটার দিকে আর না-কানোর। কিন্তু তারপর একটা সময় এল যখন আর ভিজিটর আসছিল না, টেলিফোনেও আর কোনও শব্দ নেই, শূন্য ঘরে মেয়েটি ও সে দুরন্ত নিস্তব্ধতার মধ্যে বসে ছিল।
তারপর টেলিফোনের ক্র্যাডল থেকে রিসিভার তোলার শব্দ, তারপর দ্রুত ডায়াল করবার মিষ্টি শব্দ হচ্ছিল। তখন মেয়েটি ব্যস্ত আছে ভেবে সন্তর্পণে একবার চোখ তুলেই ভয়ংকর চমকে উঠল শ্যাম। মেয়েটি বাঁ হাতে টেলিফোনটা কানের কাছে ধরে রেখেছে, ডান হাতে সামনের রিসেপশন কাউন্টারে একটা হলুদ পেনসিল ধরে আছে, কিন্তু সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে শ্যামের দিকে। চোখে পড়তেই সে পেনসিলটা রেখে দ্রুত তার ডান হাত তুলে মাউথপিসটা চাপা দিল, পরমূহুর্তে সে পাখির মতো তীক্ষ্ণ মিষ্টি গলায় সোজা তাকে প্রশ্ন করল, হুম ড়ু ইউ ওয়ান্ট, প্লিজ?
মাথার ভিতরে হঠাৎ ঘোলা জল টলমল করে ওঠে। কাকে চাই! আমি কাকে চাই! তীব্র আবেগে থরথর করে শ্যামের হাত-পা কেঁপে ওঠে। মুহূর্তেই ভুলে পেয়ে বসে তাকে। মনে পড়ে না কাকে চাই, কিছুতেই তার মনে পড়ে না। শুধু মনে হয় এতক্ষণ এইখানে—এই সুন্দর সাজানো-গোছানো ঘরে সুন্দর মেয়েটির মুখোমুখি বেমানান বসে থেকে সে এদের শৌখিন সুন্দর কোনও আবহাওয়াকে নষ্ট করে দিচ্ছিল–বাস্তবিক সে কেন এখানে বসে আছে? কেন বসে আছে?
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল শ্যাম। তার গলা আটকে আসছিল। শুধু মাথা নেড়ে জানাল, না, সে কাউকেই চায় না। সে কারও জন্য বসে নেই। এখানে তার কোনও কাজ নেই।
দরজার দিকে কয়েক পা হেঁটে যায় শ্যাম। দাঁড়িয়ে পড়ে। ভয়ে শিউরে ওঠে তার গা। লক্ষ করে, হাঁটবার সময়ে দরজাটা সরে যাচ্ছে। বাঁ থেকে ডাইনে। আবার বাঁয়ে। বড় অদ্ভুত! শ্যাম দ্রুত চোখ বুজে ফেলে। আবার হেঁটে যায় কয়েক পা। চোখ খুলে দেখে সে কাউন্টারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি ভ্রূ সামান্য তুলে তাকে দেখছে। যেন প্রশ্ন করতে চায় তুমি কে?
আমি কে! স্মৃতিহীন নির্বোধ শিশুর মতো শ্যাম অবাক চোখে অচেনা চার দিকে চেয়ে দেখে। বড় অসহায়ের মতো হাত বাড়িয়ে একটা চেয়ারের হাতল কিংবা একটা টেবিলের কিনারা খোঁজে সে। তার ঠোঁট নড়ে ওঠে, সে বিড়বিড় করে বলে, প্রশ্ন কোরো না আমি কে! আমি জানি না। বৃষ্টির জলের মতো দুঃখে তার বুক ভরে ওঠে—আমি জানি না আমি কেন গাছ হয়ে জন্মাইনি! জানি না আমি মাছ হয়ে জন্মালেই বা কী ক্ষতি ছিল।