বুঝছি রে। আর বোঝাতে হবে না। তুই সবকিছুর মধ্যে ভগবান দেখিস, আর আমি দেখি বিষয়।
তাই দেখেন কর্তাবাবু, তাই ভাল করে দেখেন।
বিষ্ণুপদ একটু ম্লান হেসে বলে, দূর পাগল! বিষয়ের মধ্যে আছেটা কী? তাও যদি নিজের জোরে করতে পারতুম তো বলার মুখ থাকত। এ হল গিয়ে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। শ্বশুরমশাই ঘর-জামাই করতে চাইল, তখন বড় গরিব ছিলুম তো, বাপের কাছে কলকে পেতুম না, তাই নেচে উঠেছিলুম। ভাবলুম না জানি চারখানা হাত গজাবে। এসে সাজানো সংসারে ঘটের মতো বসলুম। ফকিকারিটা যদি তখনও বুঝতে পারতুম রে। আজ যেন কোথায় একটা খোঁচা টের পাচ্ছি।
মানুষকে দুঃখ পেতে দেখলে সতীশের কেমন যেন জলে-পড়া অবস্থা হয়। সে একটু ব্যগ্র হয়ে বলে, তা এর মধ্যে খারাপটা কীসের দেখলেন? আমি তো কিছু খারাপ দেখছি না!
খারাপ নয়! পাঁচজন কি আর আমাকে ভাল বলে রে? আড়ালে রঙ্গ রসিকতা করে, আমি টের পাই। সম্বন্ধীরাও ভাল চোখে দেখে না। এমন কী বউ ছেলেপুলেরাও নয়। এই তো আজ জামাই এল, তার ভাবখানা যেন লাটসাহেবের মতো, শশুর বলে যে কেউ একজন আছে তা গায়েই মাখতে চায় না।
সতীশ মাথা চুলকোয়। বাবুর সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে তা ঠিক ধরতে পারছে না সে। এই হল মুশকিল। নিজেকে বাবুটাবুদের জায়গায় বসিয়ে তো আর ভাবতে পারে না। তার তো ওসব বড় বড় সমস্যা নেই। তবু সে বলল, জামাই তো দিব্যি আপনার। এই তো সেদিন বে হল! গাড়ি চেপে জামাই এল, কাছ থেকে বেশ করে দেখলুম।
বিষ্ণুপদ ঠাট্টা করে বলে, কী দেখলি? ভগবান নাকি?
সতীশ একটু লজ্জা পেয়ে বলে, কিছু খারাপ নয় তো!
বিষ্ণুপদ একটু চুপ করে থেকে বলে, খারাপ কাউকে বলি কী করে? খারাপ আমার কপাল। ভাবছি এখানে তোর কাছাকাছি একখানা ঘর তুলে থাকব। আমাকে তুই একটু চাষের কাজ শেখাবি?
কী যে বলেন তার ঠিক নেই।
তোর সঙ্গে থেকে থেকে চাষবাস শিখব, বুড়ো বয়সকে ঠেকাতে শিখব, আর ভগবান দেখতে শিখব। শেখাবি?
আজ বাবুর কথাগুলো বড় উঁচু উঁচু দিয়ে চলে যাচ্ছে। সতীশ নাগল শচ্ছে ন! কী বলতে হবে তাও মাথায় আসছে না তার।
ঠিক এই সময়ে তার বউ সুরবালা রান্নাঘর থেকে ঘোমটা ঢাকা অবস্থায় আধখানা বেরিয়ে এসে বলল, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। বাবুকে বলল এখানেই স্নান করে দুটি খেয়ে যেতে।
বিষ্ণুপদ গায়ের জামাটা খুলতে খুলতে বলে, সে কথাটাও মন নয়। খাওয়াবি নাকি রে সতীশ দুটি ভাত?
সতীশ এত অবাক হল যে বলার নয়। বাবু খাবেন! তার বাড়িতে? সে উত্তেজিত হয়ে বলে, কচুচু কী রান্না হয়েছে কে জানে! এ কি আপনি মুখে দিতে পারবেন? কত ভাল খাও-F.ওয়া হয় আপনাদের।
রোজ তো নিজের মতোই খাই। আজ না হয় তোর মতোই খেয়ে দেখি। তেলটেল থাকলে দে। স্নানটা করে আসি।
এই যে দিই।
বলে সতীশ ছোটাছুটি শুরুকরল৷ তেল এনে দিল। নিজেই গিয়ে কুয়ো থেকে জল তুলল। একখানা নতুন গামছা কিনেছিল হাট থেকে। সেইটি বের করে দিল। বিষ্ণুপদ যে সত্যিই তার বাড়িতে খেতে বসবে এটা যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না তার।
বিষ্ণুপদ সত্যিই স্নান করে এসে খেতে বসে গেল।
খেতে খেতে বলল, আমার মা এখনও বেঁচে আছে তা জানিস? গ্যাঁড়াপোতায় আমাদের বাড়ি। বহুকাল যাওয়া হয়নি। বিষয় সম্পত্তি নিয়ে এমন মজে আছি যে
সতীশ কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। মিনমিন করে বলল, মোটা চালের ভাত, গিলতে আপনার কষ্ট হচ্ছে খুব।
ছেলেবেলায় এই মোটা চালের ভাতই জুটতে চাইত না। কষ্ট ছিল খুব, আর কষ্টে থাকলে মানুষ কত কী করে ফেলে। শ্বশুরমশাই এমন লোভানীতে ফেলে দিলেন যে সব ছেড়েছুঁড়ে একেবারে পুষ্যিপুত্তরটি হয়ে চলে এলাম। একটা বড় লাফ মেরে খানাখন্দ সব ডিঙিয়ে এলুম বটে, কিন্তু একবার ফিরে দেখা তো উচিত ছিল ভাইরা, বোনরা, আমার মা-বাবা তারা ডিঙোতে পারল কি না। উচিত ছিল না, বল?
সতীশ সুরবালার দিকে চেয়ে বলে, বাবুকে আর একটু ডাল দাও বরং। আর একটু চচ্চড়িও নিন। বাল হয়নি তো বাবু?
ঝালটাই তো ব্যঞ্জন ছিল রে। ভাত পাতে আর কীই বা জুটত! শুধু লঙ্কা। বোনগুলোর একটাও ভাল বিয়ে হয়নি শুনেছি। ভাইগুলোও বড় কেউকেটা হয়নি। বাবা দুঃখে কষ্টে গেছে। মাটা এখনও খুকখুক করে বেঁচে আছে।
সতীশ উঁচু হয়ে বসে পাতে আঁকিবুকি কাটছে। তার হল চাষাড়ে খিদে। যখন খেতে বসে তখন অন্ন ব্যঞ্জনের স্বাদ পায় না, গোগ্রাসে শুধু গিলে যায়। চোখের পলকে পাত সাফ। আজ তার ভাত যেন উঠতেই চাইছে না। পাহাড়প্রমাণ পড়ে আছে পাতে।
আর পেট ভরল না বাবু।
বিষ্ণুপদ খুব ধীরে ধীরে উঠে পড়ল। আঁচিয়ে এসে বলল, এই দাওয়াতেই একটা মাদুর পেতে দে, একটু গড়িয়ে নিই। এখানে দিব্যি হাওয়া আছে।
সতীশের মেয়ে খেঁদি একটা পান সেজে এনে দিল। পান খায় না বিষ্ণুপদ। তার কোনও নেশা নেই, এক বিষয় সম্পত্তির নেশা ছাড়া। তবু আজ পানটা খেল।
আমাদের বালিশ বড় শক্ত কর্তাবাবু। তুলোর বড্ড দাম বলে পুরনো ন্যাকড়া-ট্যাকরা ভরে খোল সেলাই করে নিই। আপনার অসুবিধে হবে।
তুই অনেকক্ষণ ধরে কেবল ভদ্রতা করছিস। কাছে এসে বোস।
সতীন বসল।
আধশোয়া হয়ে অনেকক্ষণ আবার সামনের মাঠঘাটের দিকে চেয়ে চেয়ে পান চিবোয় বিষ্ণুপদ। তারপর বলে, মানুষ যে কী চায় সেটাই তো বুঝতে পারে না। তুই বুঝিস?