- বইয়ের নামঃ গয়নার বাক্স
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. সোমলতা
আমার স্বামীর নাম চকোর মিত্ৰচৌধুরি। চৌধুরিটা অবশ্য ছেঁটে ফেলেছেন। চকোর মিত্র নামেই পরিচয়। আমার আঠারো বছর বয়সে যখন বিয়ে হয় তখন আমার স্বামী ভেরেণ্ডা ভেজে বেড়ান। গুণের মধ্যে তবলা বাজাতে পারেন, আর বি.এ পাশ। ওঁদের বংশে কেউ কখনও চাকরি করেনি। পূর্ববঙ্গে ওদের জমিদারি ছিল। তার জের ছিল আমার বিয়ে অবধি। শোনা গিয়েছিল, এখনও নেই-নেই করেও যা আছে তাতে ছেলেকে আর ইহজীবনে চাকরি করতে হবে না। বউ-ভাতের আয়োজন এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া আমার গয়নাগাঁটি দেখে আমার বাপের বাড়ির লোকদেরও ধারণা হয়েছিল যে, কথাটা বুঝি সত্যি।
পড়তি বনেদি পরিবারের খুব বারফাট্টাই থাকে। লোক-দেখানো বাহাদুরি করার সুযোগ তারা ছাড়ে না। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির ভিতরকার নানা ছোটখাট অশান্তি আর তর্কবিতর্কের ভিতর দিয়ে জানতে পারি যে, আমার বিয়েতে খরচ করতে গিয়ে তাদের সম্বল প্রায় শেষ। উপরন্তু বাজারে বেশ ধারও হয়েছে।
শাশুড়ি মানুষটি বেশ ভালই ছিলেন। শান্তশিষ্ট এবং খুবই সমবেদনাশীলা। গরিব এবং ধার্মিক পরিবারের মেয়ে তিনি। এ বাড়ির সঙ্গে ঠিকঠাক মিলেমিশে যেতে পারেননি। তিনি আমাকে ডেকে একদিন কাছে বসিয়ে বললেন, ফুচু-র (আমার স্বামীর ডাক নাম) সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছে। সেটা তোমার কপাল। ফুচু ছেলে খারাপ নয়। কিন্তু আমাদের শুধু এখন খোলাটা আছে, সার নেই। বিয়ে দিয়েছি, যদি বউয়ের ভাগ্যে ওরও ভাগ্য ফেরে। কোমর বেঁধে ওর পেছনে লেগে থাকো। আস্কারা দিও না। একটু লাই দিলেই শুয়ে-বসে সময় কাটাবে। এ বাড়ির পুরুষদের ধাত তো জানি। বড় কুঁড়ে।
কথাটা শুনে আমার দুশ্চিন্তা হল। বিয়ের পর যদি আমার স্বামীর ভাগ্য না-ফেরে তবে কি এরা আমাকে অলক্ষুণে বলে ধরে নেবেন?
শাশুড়ি দুঃখ করে বললেন, এ সংসার চলছে কিভাবে তা জানো? জমি আর ঘরের সোনাদানা বিক্রি করার টাকায়। বেশিদিন চলবে না। যদি ভাল চাও তো ফুচুকে তৈরি করে নাও।
ভয়ে ভয়ে বললাম, আমি কি পারব মা? উনি কি আমার কথা শুনে চলবেন? যা রাগী মানুষ!
শাশুড়ি হেসে ফেললেন, পুরুষের রাগকে ভয় পেতে নেই। ওদের রাগটা হল শুধুই পটকার ফাঁকা আওয়াজ। বেশি পাত্তা দিও না।
কী করতে হবে তা কি আমাকে শিখিয়ে দেবেন?
ওসব শেখাতে হয় না মা। তোমার মুখ দেখে তো মনে হয় বেশ বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। নিজেই ঠিক করে নিতে পারবে কী করতে হবে।
শাশুড়ির সঙ্গে সেইদিন থেকেই আমার একটা সখিত্ব গড়ে উঠেছিল। শাশুড়িদের সম্পর্কে যা সব রটনা আছে তাতে বিয়ের আগে খুব ভয় ছিল। আমার ভাগ্য ভাল যে, শাশুড়ি দজ্জাল নন।
তবে দজ্জালের অভাব সংসারে কখনও হয় না। আমার একটিমাত্র জা, বয়সে বড়। ইনি প্রচণ্ড দজ্জাল। আর একজন বালবিধবা এক পিসশাশুড়ি। বলতে গেলে ইনিই সংসারের সর্বময় কত্রী। অল্পবয়সে বিধবা হওয়ায় তাঁর দাদা ও ভাই তাঁকে স্নেহবশে তোলা-তোলা করে রেখেছেন। ফলে এ সংসারে এঁর দাপট দেখার মতো।
উত্তরবঙ্গের যে শহরে শ্বশুরবাড়ির লোকদের বাস তা ঘিঞ্জি, নোংরা এবং ছোট। জীবনযাত্রায় কোনও বৈচিত্র্য নেই। এঁদের বাড়িটা বেশ বড়। পাকিস্তানে এঁদের আরও বড় এবং অনেকগুলো বাড়ি, প্রচুর জমি ইত্যাদি ছিল। এ বাড়িটাও এঁদের আগে থেকেই ছিল। আমার দাদাশ্বশুর তৈরি করিয়েছিলেন। জমিদারবাড়ি যেমন হয় তেমনি। অনেক ঘর, খিলান, গম্বুজওলা জবরজং ব্যাপার। ভাগিদারও কম নয়। দেশ পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় আত্মীয়স্বজনরা এসে সবাই এ বাড়িতেই আশ্রয় নেন। তাঁদের প্রথমে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল দুর্গত হিসেবে। কিন্তু পরে তাঁরা দাবি তোলেন, এ বাড়ি যখন এস্টেটের টাকাতেই তৈরি তখন এতে তাঁদেরও ভাগ আছে। বাড়িটা দাদাশ্বশুরের নামে, ওয়ারিশান আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, এক জ্যাঠাশ্বশুর ও তাঁর মেয়ে, ভাসুর ও স্বামী। কিন্তু সেটা হল কাগজপত্রের মালিকানা। যাঁরা দখল করে বসেছেন তাঁরা দখল ছাড়েননি। মামলা-মোকদ্দমা চলছে অনেকদিন ধরে। সেইসঙ্গে কিছু ঝগড়া কাজিয়াও। তবে পালপার্বণে, বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ ইত্যাদিতে গোটা পরিবার একত্র হয়ে যায়।
এসব বুঝে উঠতে এবং লোকগুলোকে চিনে নিতে আমার কিছু সময় লেগেছিল। একটু বড় বড় কথা বলা এবং সুযোগ পেলেই দেশের বাড়ির জমিদারির গল্প করা এঁদের একটা প্রিয় অভ্যাস। এ বাড়ির পুরুষদের চাকরি-বাকরি-ব্যবসা ইত্যাদিতে আগ্রহ ছিল না। বেশি নজর ছিল ফূর্তির দিকে। তবে আমার যখন বিয়ে হয় তখন বাঁচার তাগিদে কেউ কেউ রুজিরোজগারে মন দিয়েছেন।
আমার স্বামী সম্পর্কে বলতে গিয়েই এত কথা বলা। স্বামী জমিদারবাড়ির ছেলে, আদরে আলস্যে মানুষ। লেখাপড়ার চাড় কম ছিল বলে গড়িয়ে গড়িয়ে বি.এ পাশ। মেজাজটা একটু উঁচু তারে বাঁধা। যখন তবলার রেওয়াজ করেন তখন একটুও বিরক্ত করা চলবে না। ঘুম থেকে ডেকে তুললে রেগে যান। উনি উঠবেন ওঁর ইচ্ছেমতো। বউকে নিয়ে কোথাও যাওয়া ওঁর পোযায় না। স্ত্রীর বুদ্ধি পরামর্শ নেওয়া ওঁর কাছে অপমানজনক।
বয়সে উনি আমার চেয়ে বেশ কিছুটা বড়। আমার আঠারো, ওঁর বত্রিশ। বয়সের এ পার্থক্য নিয়ে আমি আপত্তি তুলিনি, কারণ, আমি একটু বয়স্ক মানুষকেই স্বামী হিসেবে পেতে চেয়েছিলাম। আর আমার বাপের বাড়ি এতই গরিব যে, পাত্রর বয়স বা চাকরি নিয়ে খুঁতখুঁত করা আমাদের পক্ষে শৌখিনতা। তবে বলতে নেই, বয়স বত্রিশ হলেও আমার স্বামী দেখতে অতি চমৎকার। টান লম্বা, ফর্সা, ছিপছিপে, একমাথা ঘন কালো চুল, মুখখানাও দারুণ মিষ্টি। গায়ে যে নীল রক্ত আছে তা চেহারা দেখেই বোঝা যায়। বয়সের পার্থক্য এবং ওঁর গুরুগম্ভীর রকমসকম দেখে আমি ওঁকে ‘আপনি’ করেই বলতাম। সেই অভ্যাস আজও রয়ে গেছে।