এত সুন্দর করে বলল যে ওই সামান্য কথাতেই কেন যেন জল এল সতীশের চোখে। সে ধরা গলায় বলল, তোমার ভাল হবে বাবা, তুমি বড় ভাল ছেলে।
ছেলেটা খুশি হয়ে নদীর ধার দিয়ে কোথায় চলে গেল। সতীশ কাউকে কিছু বলেনি, বলতে নেই। মনে মনে সে জানে, সেদিনই সে ভগবানকে দেখেছে।
দুপুরবেলা দুটো তৃষ্ণার্ত বলদকে একটা মাটির গামলায় নুন মেশানো জল খাওয়াচ্ছিল সতীশ। উঠোনে একটা ছায়া এসে পড়ল।
সতীশ, আছিস নাকি রে?
মনিবকে দেখে সতীশ তটস্থ হল। বাঁকা নদীর পোল পেরিয়ে মনসাতলা দিয়ে টুকটুক করে ছাতাটি মাথায় দিয়ে উনি নিত্যই আসেন। আসেন, এসে চাষের সময় ক্ষেতের ধারে আলের ওপর বসে থাকেন। ধান ঝাড়া হলে দেখতে আসেন। ধান মাপবার সময় দেখতে আসেন। কী দেখেন তা সতীশ জানে। বিঘে প্রতি যা ন্যায্য পাওনা হয় তা সতীশ বরাবর তুলে দিয়ে আসে মনিবের গোলায়। খরা বা বান হলে কম বেশি হয়।
মেয়ে খেঁদি দৌড়ে গিয়ে একটা জলচৌকি এনে পেতে দিল দাওয়ায়। মুখের ঘামটি কোঁচায় মুছে মুনিব বসলেন। ফর্সা মুখখানা রোদের তাতে রাঙা হয়ে আছে। চুল আর গোঁফ কিছু পেকেছে, তবু মান্যিগন্যি করার মতোই চেহারা।
খেঁদির কাছে চেয়ে এক ঘটি জলের অর্ধেকটা খেয়ে নিলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ আছিস তোরা।
এ কথাটার মানে হয় না। শুনলে লজ্জা করে সতীশের। ভাল থাকা মন্দ থাকার সে কীই বা জানে। তবে মেখেজুখে আছে, মিলেমিশে আছে। চারদিকটার সঙ্গে তার ভারী ভাবসাব। মনে হয় পোকাটা মাকড়টা অবধি তাকে চেনে জানে।
সে মনিবের সামনে উঠোনে উবু হয়ে বসে বলে, দুটো ডাব পাড়ি?
ডাব! না. রে, এ দুপুরে তোকে আর গাছে উঠতে হবে না।
কিছু নয় কর্তাবাবু। হনুমানের মতো উঠব আর নামব। যাওয়ার সময় কয়েকটা গন্ধরাজ লেবু নিয়ে যাবেন। এবার মেলা ফলেছে।
ডাবটা আস্তে আস্তে খেতে খেতে মনিব বললেন, সেই শ্বশুরমশাইয়ের আমল থেকে তোকে দেখে আসছি। একই রকম রয়ে গেলি। তুই বুড়ো হস না?
সতীশ মাথা চুলকে বলে, বয়স ভাঁটিয়ে গেছে অনেক দিন। সে কি আর আজকের কথা! বুড়োও হচ্ছি নিশ্চয়ই, বয়স তো হলই।
সেইরকম পাকানো চেহারা, শক্তপোক্ত, সারাদিন রোদে জলে খাটিস, বয়স মানিস না, তোর কেমটা বুঝতে পারি না।
ওই আজ্ঞে একরকম। চাষাভুষোর শরীর তো।
ওরে, আমিও পালোয়ান কিছু কম ছিলাম না। দেখেছিস তো সেই চেহারা!
আজ্ঞে দেখিনি আবার! সব চোখের সামনে ভাসছে। যেদিন বিয়ে করতে এলেন নৌকো করে, পালকি ঘাড়ে করে নিয়ে গিয়েছিলাম! বুড়োকর্তার সে কী আত্মদ কার্তিকের মতো জামাই হয়েছে।
আর লজ্জা দিস না। আজকাল নড়তে চড়তে হাঁফ ধরে যায়।
শরীর তো কিছু বেজুত দেখছি না আমি। অনেকটা সেইরকমই আছেন।
বিষ্ণুপদ উদাস চোখে মাঠঘাট পেরিয়ে কোন উধাওয়ের দিকে যেন চেয়ে থাকে। তারপর একটু ধরাধরা গলায় বলে, বিষয়-বিষয় করেই বোধহয় এরকম ধারা হল, কী বলিস!
গন্ধরাজ লেবু কটা কুয়োর জলে ধুয়ে এনে দাওয়ার ওপর রেখে সতীশ বলে, আপনার বিষয় না থাকলে আমার পেট চলত কী করে? আপনার জমিতে চাষ, আপনার ভুঁয়েই বাস।
বিষ্ণুপদ বড় বড় চোখে কেমন বিকল একরক নজরে সতীশের মুখের দিকে চেয়ে বলে, ঠিক জানিস?
কীসের কথা বলছেন?
এ জমি যে আমার, এই চাষবাস যে আমার।
তা কে না জানে! হরপ্রসন্নবাবু আপনার নামে লিখে দেননি এসব?
কর্তাবাবুর আজ বড় বড় শ্বাস পড়ছে, লক্ষ করে সতীশ। মুখখানাও ভার। আজ বাবুর মনটা ভাল নেই। মন নিয়ে কারবার নেই সতীশের। তার মন বলে কি বস্তু নেই? থাকলেও ঠাহর পায় না। সকাল না হতেই কাজে নেমে পড়তে হয়। শরীর বেটে দিতে হয়, জান চুয়াতে হয়, তবে মাঠে মাঠে ফলন্ত মা লক্ষ্মীকে দেখা যায়। তখন শরীরে কেমন একখানা ফুরফুরে হাওয়া এসে লাগে।
বিষ্ণুপদ ডাবের খোলাটা সতীশের বাড়ানো হাতে ধরিয়ে দিয়ে ধুতির খুঁটে মুখ মুছে বলেন, লিখেই তো দিয়েছিলেন রে। তুই তো লেখাপড়া শিখিসনি, দলিলে কী লেখা থাকে তাও জানি না।
সতীশ গম্ভীর মাথা নেড়ে বলে, তা অবশ্য জানি না। তবে এটা মনে হয় কোন জমিটা কার তা স্পষ্ট করে বলা থাকে দলিলে।
তাও থাকে। তবে আমরা হচ্ছি ভাড়াটে। আসল জমি হল সরকার বাহাদুরের। ভোগ দখল বিক্রি, বা বিলিব্যবস্থার অধিকার আছে মাত্র। সরকার ইচ্ছে করলেই কেড়ে নিতে পারে।
সতীশ মাথা নেড়ে বলে, সে কথাও ঠিক নয়। এই আলো বাতাস এসব তো সরকার বাহাদুরের নয়, নাকি?
আলো বাতাস! তা কী কবে সরকারের হতে যাবে?
তা হলে জমিও নয়। দুনিয়াটা যার এসব হচ্ছে তারই জিনিস।
বিষ্ণুপদ সতীশের দিকে মায়াভরে চেয়ে থেকে বলে, তোর মধ্যে এই একটা জিনিস আছে। এটাই তোকে বুড়ো হতে দেয় না। এর জন্যই এই বয়সেও তোর গায়ে মেষের মতো জোর। তোর মতো নয়, তাহলেও শশুরমশাইয়ের মধ্যেও এরকম একটা ব্যাপার ছিল।
তিনি ছিলেন আমার অন্নদাতা দেবতা। ওরকম মানুষ হয় না।
বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলে, তুই তো স্বার মধ্যেই ভগবান দেখতে পাস। এ খুব ভাল। আমাকে শেখাবি কী করে সব কিছুর মধ্যে ভগবানকে দেখতে হয়?
সতীশ লজ্জায় মুখ নিচু করে হাসে, কী যে বলেন তার ঠিক নেই। আমি শেখাব কি? মুখ সুখ মানুষ আমরা। ওসব আস্পর্ধার কথা শুনতে নেই। তবে এটা জানি, জমির মালিক যদি আপনি না হন তবে সরকার বাহাদুরও গয়। আপনার যা বন্দোবস্ত সরকার বাহাদুরেরও তাই।