তাকে ভাবিত দেখে সাতকড়ি এতক্ষণ কথা বলেনি। এবার বলল, তোমার বরাত হল সোনার ফ্রেমে বাঁধানো। নিজের বিয়ে যেমন বোমা ফাটিয়ে করলে, মেয়েটারও তেমনি।
২. কৃষ্ণকান্ত ঝুঁকে নদী দেখছিল
০২.
পোলের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকান্ত ঝুঁকে নদী দেখছিল। ব্যাটারা পোলটা বানিয়েছে ভাল। দিব্যি তকতকে জায়গা। বর্ষাবাদল না থাকলে শুয়ে ঘুমোনো যায়। বসে ভাত খাওয়া যায়। ঝড়বৃষ্টি হলে পোলের তলায় সেঁধিয়ে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকলেই হল। পোলটা হয়ে ইস্তক কৃষ্ণকান্ত এখানেই থানা গেড়েছে। বড় পছন্দের জায়গা। কত উঁচু! এখানে দাঁড়ালে কতদূর অবধি দেখা যায়, আর হাওয়া বাতাসও খেলে।
সবাই জানে না, কিন্তু কৃষ্ণকান্ত খবর রাখে, পোল বাঁধতে তিনটে নরবলি হয়েছিল, বাজঠাকুরকে পাঁচখানা পাঁঠা মানত করতে হয়েছিল। তাতেও হয়নি। রোজ ব্যাটারা থাম বানাত আর নিশুত রাতে হারুয়া-ভূত এসে থাম নড়িয়ে গোড়া আলগা করে রেখে যেত। শেষে বাতাসপুরের শ্মশন থেকে হাতে-পায়ে ধরে নকুড় তান্ত্রিককে এনে ভূত বশ করতে হয়েছিল।
কিন্তু এত করেও লাভটা হল লবডঙ্কা। পোল বানানো হল বলে বাঁকা নদী রাগ করে সেই যে শুকোনো শুরু করল, এখন তো লোপাট হওয়ার জোগাড়। শালারা নদীকে গয়না পরাতে গিয়েছিল। বেহদ্দ বেকুব না হলে মা মুক্তকেশীকে কেউ গয়না পরায়? বাঁকা নদীর জলে চান করলে আগে পুণ্যি হত। কৃষ্ণকান্ত রোজ নিশুত রাতে পোলের তলায় শুয়ে শুনতে পায়, হারুয়া-ভূত নদীর দু ধারে দুই ঠ্যাং ফাঁক করে রেখে ছ্যাড়ছ্যাড় করে নদীতে পেচ্ছাপ করছে। এখন খা শালারা ভূতের মুত।
কৃষ্ণকান্ত রেলিং থেকে ঝুঁকে নদী দেখছে আর আপনমনে হাসছে। নদীর যত বৃত্তান্ত তা তার মতো আর কেউ জানে না। নন্দবাবুর মেয়ে শেফালি পোল থেকে লাফিয়ে পড়ে মলো–এ বৃত্তান্ত দাই জানে। বিষ্ণুপদর ছেলে জ্ঞানের সঙ্গে তার একটু ইয়ে ছিল। টের পেয়ে নন্দবাবু খুব ঠ্যাঙায়। অপমানে শেফালি এসে ঝাঁপ খেল। কিন্তু কেউ জানে না, বাঁকা নদী কিছুদিন হল খুব ডাকাডাকি করছিল শেফালিকে। পরীক্ষায় ফেল হয়ে বিশ্বেসদের ফটিকও ঝাঁপ খেল। সে কি এমনি এমনি? বাঁকা রোজ সব কচিকাঁচা ছেলেপুলেকে ডাকছে। একটি দুটি করে এসে ঝাঁপ খাবে আর মরবে।
তারপর যে কাণ্ডখানা হয় সেটাও কেউ টের পায় না। কৃষ্ণকান্ত পায়। মরা মেয়ে বা ছেলের জন্য মা-বাপেরা যখন কান্নাকাটি করছে তখন শেফালি দিব্যি বাঁকা নদীর বালিয়াড়িতে দাগ কেটে এক্কাদোক্কা খেলে আর ছুটোছুটি করে বেড়ায় মনের আনন্দে। ফটিকই বা কোন দুঃখে আছে? হারুয়াভূতের সঙ্গে ঘুরে-ঘুরে বটফলনাটাফল পাড়ে আর খায়। ভরদুপুরে পোলের তলায় ছায়ায় শুয়ে শুয়ে আধবোজা চোখে সব দেখতে পায় কৃষ্ণকান্ত। মাঝে মাঝে হরপ্রসন্নবাবু এসে পোলটার দিকে চেয়ে খুব রাগারাগি করেন, এত জল ছিল নদীতে, সব গেল কোথায়? অ্যাঁ! গেল কোথায় অত জল? এই বলে ইয়া বড় বড় ঢ্যালা তুলে পোলের গায়ে ভটাভট ছুঁড়ে মারেন। ঠিক দুকুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা।
পোলটাকে ঘুরেফিরে সারাদিনই দেখে কৃষ্ণকান্ত। ঝাঁ ঝাঁ করে যখন বাস আর লরি পার হয় তখন শব্দটা যা ওঠে তাতে বুকটা ঝনঝন করতে থাকে। পোলের তলায় বসে থাকলে মনে হয়, এই বুবিধ। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। আবার যখন বাতাস বয় তখন পোলটার গায়ে বাতাসের ঘষটানির শব্দটা কেমন যেন বড় বড় শ্বাসের আওয়াজ তোলে।
রেলিংটা বেশ চওড়া। উঠে হাঁটাহাঁটি করা যায়। মজাও খুব। কৃষ্ণকান্ত উঠে পড়ল রেলিং-এর ওপর। তারপর হাঁটতে লাগল। বাঁ ধারে বাঁকা নদীর খাদ, ডানধারে পাকা রাস্তা। বেশ লাগছে তার।
পোলের মুখে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে চাকা বদলাচ্ছে। ক্লিনারটা চেঁচিয়ে বলে, এই শালা পাগল, পড়ে যাবি যে!
কৃষ্ণকান্ত খুব হাসে, পড়ব মানে! পড়লেই হল! এ হল আমার পোল। সেঁটে ধরে রাখে।
এদিককার লোকগুলো সুবিধের নয়। বড় লাথিঝাটার ঝোঁক এদের। যতদিন হরপ্রসন্ন বেঁচে ছিলেন ততদিন তেমন চিন্তা ছিল না কৃষ্ণকান্তর। চণ্ডীমণ্ডপে পড়ে থাকত। হরপ্রসন্ন মরার পর চণ্ডীমণ্ডপ গেল ঘরজামাই বিষ্ণুপদর ভাগে। সে ব্যাটা বজ্জাতের ধাড়ি। প্রথমটায় চোখ রাঙিয়ে, পরে মেরে ধরে তাড়াল। গিয়ে উঠেছিল হাটখোলার এক চালার নীচে। চৌকিদার শিবু এসে একদিন বলল, প্রতি রাতের জন্য চার আনা করে পয়সা লাগবে। তা সেখান থেকেও উঠতে হল। কিন্তু শালারা বুঝতে চায় না যে, মানুষের একটা মাথা গোঁজবার জায়গা চাই। এই পোলটা হয়ে ইস্তক তার একখানা ঘরবাড়ি হয়েছে। পোলের তলায় ওপরে যেমন খুশি শোয়, বসে থাকে, ঘুরে বেড়ায়, কারও কিছু বলার নেই।
একটা বাস ঢুকছে কুসুমপুরে জানলা দিয়ে লোকগুলো হাঁ করে তাকে দেখছে। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, গেল শালা মায়ের ভোগে।
না, অত সহজে যাচ্ছে না কৃষ্ণকান্ত। পোলের রেলিং ধরে সে রোজ হাঁটাহাঁটি করে। সে বুঝতে পারে, এ হল তার নিজের পোল। সরকার বাহাদুর তার জন্যই বেঁধে দিয়েছেন। এ হল তার তেতলা বাড়ি! পুব ধারের প্রান্তে এসে আবার ঘুরে পশ্চিমধারে এগোতে থাকে সে।
ছাতা মাথায় গুটিগুটি হেঁটে একটা লোক আসছিল। তাকে দেখে একটা লাফ মেরে পোলের শানের ওপর নামল কৃষ্ণকান্ত।
ঘরজামাই যে, একখানা বিড়ি ছাড়া তো!