বুড়ি একটু বাদে চোখ খুলে চাইল। চোখের পাতাটা খুলতেও যেন কষ্ট, বাকি পথটা আর দাঁড়ানোর চেষ্টা করল না বুড়ি। গুঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে কচুবনের কাছে এসে নোংরাটা ফেলল।
কতকাল যেমন করেন বোল নেই। আজকাল কেউ তো আর চান করিয়ে দেয় না। কুয়ো থেকে জল তুলে চান করবে তার সব্যি কী?সামনে পুকুরটা দেখে বড় লোভ হল, একটু ডুব দিয়ে নিলে হয় না?
কিন্তু পারবে কি? তাদের বানো ঘাটে, পা ঠিক রাখা মুশকিল। আর এ পুকুরের ধারেই ডুবজল। বুড়ি ভাবে, সাঁতার সে জনতৃম, কিন্তু সে জানা কি আর কাজে দেবে? আজকাল বড় ভয় করে। সব কিছুকে বড় করে।
বুড়ি বসে আর একটু জিরোলো। গলাটা শুকিয়ে আছে তেষ্টায়। কিন্তু ফিরে তাকালেই আবার তেপান্তরের মাঠ মনে হয় উঠানটাকে। কত দূরে সব সরে যাচ্ছে! ঘর, মানুষজন, ছেলেমেয়ে। বুড়ি চোখ বোজ। হাজারো শখের বৃষ্টি মাথায় ঝরে পড়তে থাকে।
ও ঠাকমা, জঙ্গলে বসে কীছ তখন থেকে? ও ঠাকমা…
এই একটা মাত্র নাতনি নাচুনিই তার যা একটু খোঁজখবর নেয়। কাছে বেশি আসে না, এলে মা বকবে। তবু একটু টান আছে, একটু মায়া।
বুড়ি কথা বলতে গিয়ে দেখল, গলায় কেন যেন স্বর নেই। কিছুতেই একটাও কথা গলায় তুলে আনতে পারল না বুড়ি।
ও ঠাকমা, অমন করছ কেন? ঘরে যাও।
বুড়ি চোখ বুজে ভাবল মরে গেছি নাকি? ছেলেরা ঠিকমতো শ্রাদ্ধটা করবে তো! শ্রাদ্ধ করে বড় ছেলে। তা বুড়ির বড় ছেলে হল বিটু। তাকে কি খবরটা ঠিকমতো দেবে এরা? মুখাগ্নি তো সে আর পেরে উঠবে না। অতটা রাস্তা, খবর পেয়ে আসতে আসতে মড়া বাসি হবে। নাঃ, বাঁচাটা যেমন ভাল ছিল না, মরাটাও তেমন ভাল হল না বুড়ির।
ও ঠাকমা?
কাকে ডাক ছুড়িটা? মরে পড়ে আছি এখানে, দেখতে পায় না নাকি? কানে ঝিঁঝি ডাকছে। হাত পা সব ঠাণ্ডা মেরে গেছে। বুকখানা যেন পাথর। আর মাথাটা অন্ধকার।
ও ঠাকমা। ঠাকমা গো! ওঠো না। বলে গায়ে ধাক্কা দেয় নাচুনি।
বুড়ি দেখল, না, এখনও মরেনি সে। ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল, একখানা কাঁকলাস হাত বাড়িয়ে মাটিতে রাখল।
একটা শ্বাসও পড়ল ফোঁস করে।
ও ঠাকমা! তোমার কী হয়েছে?
বুড়ি নাতনির দিকে চেয়ে মুখখানা মায়া ভরে দেখল। কত কাছে, কিন্তু কত দূর! বলল, একটু ধন্দ লেগেছিল রে। এখন ঠিক আছি।
ধরে তুলব তোমায়?
ঘেন্না পাবি না তো!
বাঃ, তোমাকে আবার ঘেন্না কীসের? মা বকবে বলে, নইলে তোমার ঘর তো রোজ আমিই পরিষ্কার করতে পারি।
অত জুড়িয়ে দেওয়া কথা বলিসনি রে, ওতে মায়া বাড়ে।
এখন আমাকে শক্ত করে ধরো তো! তোমাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি।
নাচুনি ধরে ধরে ঘর অবধি নিয়ে এল। একটা ভেজা ন্যাতা এনে দিল ছুটে গিয়ে, ও ঠাকমা, গুয়ের জায়গাটা লেপে দাও। নইলে বকুনি খাবে।
দিই। বলে বুড়ি উবু হয়ে বসল। মনটা বড় চঞ্চল হয়েছে। মুখাগ্নি কে করবে, শ্রাদ্ধটা হবে কি না, এ সব ভেবে বড্ড উচাটন লাগছে। বিষ্ণু যদি সময়মতো খবর না পায়, তা হলে কী হবে? এদের মোটে গা নেই যে!
উঠোনের রোদে বাচ্চারা খেলছে। তারই মধ্যে কে একজন চটি ফটফটিয়ে উঠে এল দাওয়ায়। বুড়ির মেজো ছেলে কৃষ্ণপদ।
আজও ঘরে হেগে ফেলেছ শুনলাম!
বুড়ি সভয়ে চেয়ে থাকে ছেলের দিকে। এদের মুখচোখের চেহারা মোটেই ভাল নয়। কেমন যেন রাগ রাগ ভাব। কখন যে বকাঝকা করবে তার কোনও ঠিক নেই।
না বাবা, সে একটা বেড়ালের কাণ্ড।
কৃষ্ণপদ মহা বিরক্ত গলায় বলে, এ বাড়িতে বাস করাই যে কঠিন করে তুললে! এরকম হলে তো মুশকিল দেখছি।
বুড়ির বুক গুড়গুড় করতে থাকে। কী বলবে তা ভেবে পায় না। কথার বড় ফের থাকে। কখন কোন কথাটায় লোকে দোষ ধরে তার কিছু ঠিক নেই।
এরকম চললে আর দাওয়ার কিন্তু জায়গা হবে না। গোয়ালঘরটা খালি পড়ে থাকে, ওটায় গোবর দিয়ে দেবখন। ওটাতেই থেকে গিয়ে।
বুড়ি তেমনি চেয়ে থাকে। গোয়াল আর এর চেয়ে কি খারাপ হবে? বুড়ি মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।
কৃষ্ণপদ ঘরে গেল। বুড়ি বিছানায় উঠে একখানা কাঁথা টেনে গায়ে দিয়ে বসল। কখন শীত করে, কখন হাঁসফাঁস করে ভেতরটা তার কিছু ঠিক নেই। আজ কী দিয়ে ভাত দেবে এরা? মুখে বড্ড অরুচি কিন্তু পেটে খিদে থাকে। একটু লেবু হলে দুটি খাওয়া যেত।
বেড়ালটা ঘরে এসে একখানা ডন দিয়ে লাফিয়ে বিছানায় উঠল। রোজই ওঠে। তাড়ালেও যায় না। তা ওঠে উঠুক। একটা প্রাণ তো৷ কাছাকাছি আর একখানা বুকও ধুকধুক করছে জানলে কেমন যেন একটু ভরসা হয়।
বেড়ালটার দিকে চেয়ে বুড়ি বলে, আজ বড় জ্বালিয়েছিস মুখপুড়ি।
বেড়ালটা চোখ মিটমিট করে ফের কাঁথাখানির মধ্যে আরামে পুঁটুলি পাকিয়ে চোখ বুঝল। বড় মায়া।
নাতজামাই পাঁচটা টাকা প্রতিবারই হাতে গুঁজে দিয়ে যায়। বুড়ি সেই টাকাটা পরে আর খুঁজে পায় না কিছুতেই। বালিশের তলায় না, তোশকের তলায় না, চাদরের তলায় না, আঁচলে বাঁধা না। কাউকে জিজ্ঞেস করা মহাপাপ। জিজ্ঞেস করলেই বলবে, চুরি করেছি নাকি?
পরশু না কবে যেন এসেছিল নাতজামাই। টাকাটা সেই থেকে খুঁজছে বুড়ি। পাচ্ছে না। পাবে না, জানা কথা। টাকা দিয়ে কিছু করেও উঠতে পারবে না সে। তবে ঘাটখরচার অভাবে গরিবগুরবোরা যেমন মড়া না পুড়িয়ে মুখাগ্নি করে জলে ফেলে দেয় তার বেলাতেও যেন ছেলেরা অমনিধারা না করে তার জন্যই কেষ্ট আর হরির হাতে টাকাগুলো দেওয়ার ইচ্ছে ছিল বুড়ির। হল না। ঘাটখরচাটা পেলে আর মড়া নিয়ে হেলাফেলা করত না।