তাই বুঝি?
খুব মজা হয় সারাদিন। কত রগড় দেখতে পাই।
বলতে বলতে নিজেই উঠে পড়ল কৃষ্ণকান্ত। একটু ককিয়ে উঠল ব্যথায়।
গোবিন্দ পাঁচটা টাকা তার হাতে দিয়ে বললে, নাও, জিলিপি খেয়ো।
টাকাটা ছেঁড়া জামার পকেটে রেখে নেমে এল কৃষ্ণকান্ত, দুর শালা? এটা একটা বাজে জায়গা, শতরঞ্চি বালিশ কি আমাদের পোয়? পোলের নীচে দিব্যিথাকি। বাবু, বিড়ি দেবেন একটা।
নেই রে।
বিড়ি ছাড়াও চলে কৃষ্ণকান্তর। বিড়ি পেলেও চলে। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে গোবিন্দর পিছু পিছু এগোতে লাগল। গোবিন্দ মাঝে মাঝে তার দিকে ফিরে চাইছে। রাগটা কমে যাচ্ছে তার।
৬. গু বউমা
০৬.
ও কি আমার গু বউমা?
আপনার নয় তো আবার কার? বাড়িটা যে নরক বানিয়ে ফেলেছেন! এখন কে এসব পরিষ্কার করে বলুন তো! হাঁটতে তো একটু আধটু পারেন, আর উঠোনটুকু পেরোলেই তো পায়খানা। শয়তানি বুদ্ধি থাকলে কে আর কষ্ট করতে যায়, তাই না?
বুড়ি খুব দুশ্চিন্তা মুখ নিয়ে বলে, এ তো মনে হয় বেড়ালটার কাণ্ড বউমা।
বেড়ালের আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, আপনার ঘরে হাগতে এসেছে। লোক ডেকে পরিষ্কার করাতে পয়সা লাগে, বুঝলেন? ঘরভরা তো আর দাসি চাকর নেই। ছিঃ ছিঃ!
বুড়ি আজকাল বড় ভয় পায়। সারাটা দিন মনে ধ ভয় আর ভয়। কখন বয়সের দোষে কোন অকাজটা করে ফেলে তার ঠিক কী? এরা কেউ ছাড়বার পাত্রপাত্রী তো নয়। বাক্যে একেবারে পুড়িয়ে দেয়।
বড় নাতনি নাচুনি এসে মাটির হাঁড়ির ভাঙা দুটো চারা আর এক খাবলা ছাই দরজার পাশে রেখে বলল, ও ঠাকমা, গুটা তুলে পিছনের কচুবনে ফেলে দিয়ে এসো।
বুড়ি নাতনির দিকে চেয়ে বলে, এই যে যাই।
উঠোনে দাঁড়িয়ে বড় বউ পুতুল পাড়া জানান দিয়ে চেঁচাচ্ছে তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তবু কি নোলা বাবা। এটা দাও, সেটা দাও। গুচ্ছের খাবে আর ঘরদোর নোংরা করবে। সামলাতে যখন পারো না তখন খাওয়া কেন বাপু? কাল এই এককাঁড়ি কলমি শাক গিলল। তখনই বুঝেছিলুম ঠিক পেট ছাড়বে।
বুড়ি মন দিয়ে শুনছিল। গতকাল কলমি শাকই খেয়েছিল বটে। কিন্তু বুড়ির গলায় তত জোর নেই যে পাল্টা চেঁচিয়ে সবাইকে জানাবে, কলমি শাক ছাড়া আর কোনও পদই তাকে দেওয়া হয়নি।
নাচুনি চাপা গলায় বলে, তাড়াতাড়ি করো ঠাকমা, দেরি করলে আরও কবে।
এই যে যাই।
মাথাটা আজ বশে নেই। কেমন যেন পাক খাচ্ছে। শরীর কিছুতেই খাড়া হতে চায় না। বুড়ি চৌকি থেকে নেমে নোংরাটার সামনে উবু হয়ে বসল। তারপর নাতনির দিকে চেয়ে বলে, এটা বেড়ালের কাণ্ড নয়, তুই-ই বল তো!
বেড়ালগুলোকে ঢুকতে দাও কেন?
ঢুকবে না কেন বাবা, কোন আগল দিয়ে আটকাব! এ যে খোলা ঘর।
বুড়ি নোংরাটা চেঁছে মাটির সরায় তুলল। কচুকনটা যে কত দূর বলে মনে হয়। খিল ধরা হাঁটু আর টলমলে মাথা নিয়ে অতদূর যাওয়া মানে যেন তেপান্তর পার হওয়া।
মেলা পাপ জমেছে বাবা। পাপের পাহাড়। সব ক্ষয় করে যেতে হবে তো…
উঠোন পেরিয়ে পুকুরের ধারে সেই কচুকন যেন এক অফুরান মরুভূমি। বয়সকালে বুড়ি এই উঠোনেই উদূখলে সর্ষে গুঁড়ো করত, টেকিঘরে পাড় দিত, পাঁজা পাঁজা বাসন মেজে নিয়ে আসত ঘাট থেকে। সেই শরীরই তো এইটে। সেই উঠোন। কিন্তু আজ আর বনিবনা নেই কারও। শরীরের সঙ্গে না, উঠোনের সঙ্গে না, কচুবনের সঙ্গে না।
ঢেঁকিঘর উঠে গেছে। উদূখল বিদেয় হয়েছে। ঘরবাড়িতে ধরেছে ক্ষয়। দুই বউয়ের তিন সংসার। তারা পালা করে পোষে। না পুষলে পাড়ায় নিলে হবে বলেই বোধহয় পোষে। নইলে গু-মুত, মরা ইঁদুর, আবর্জনার মতো তাকেও ফেলে দিত আস্তাকুঁড়ে।
বড় বউ মাঝে মাঝে মুখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে বলে, এখন তো রস মজে বটুমি হয়েছেন, যখন বিয়ে হয়ে নতুন বউ এসেছিলুম তখন কম ঝাল ঝেড়েছেন? উঠতে খোঁটা, বসতে খোঁটা। আর কী মুখ বাবা, কী অন্তরটিপ্পনী। চোখের জলে বিছানা ভিজত আমার। সংসারে একতরফা কিছু হয় না, বুঝলেন! এখন দান উল্টে গেছে।
উঠোনটা পেরোতে পারল কী করে তা জামগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে ভেবে পাচ্ছিল না বুড়ি। বুকটা এত ধড়াস ধড়াস কাঁপছে যে, এখনই না আবার মূর্ছা হয়। চোখে এই দিনের আলোতেও কেমন আঁধার ঘনিয়ে এল যে। কুঁজো হয়ে হাঁটার বড় কষ্ট। মাজার ব্যথায় কতকাল সোজা করতে পারেনি শরীরটাকে।
এমন হাঁফ ধরে গেছে যে জামতলার আগাছার মধ্যেই বুড়ি ধপ করে বসে পড়ে। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে চোখটা বোজে। হাতে মাটির চারায় নিঘিন্নে মল। তবে বুড়ি আর ঘেন্না পায় না। দিন রাত এসব নিয়ে মাখামাখি, ঘেন্না করবে কাকে?
আজকাল বেশিক্ষণ চোখ বুজে থাকলে একটা ভয় হয়, মরে গেলাম নাকি? ঘুমোনোর সময় মনে হয়, আর যদি না উঠি? মরার পর কেমন সব হবে তার চিন্তাও পেয়ে বসে বুড়িকে। যমদূতরী এসে তো ধরবে সব গাজি গাজি করে। অপর টানতে টানতে বৈতরণী পার করাবে। নিয়ে গিয়ে হাজির করবে যমরাজার সামনে। তাইবুড়ি পড়বে বিপদে। কী জিজ্ঞেস করে না করে কে জানে বাবা। এ দিকে ছেলেরা যে এতিটা তলরেকরবে এমন ভরসা হয় না। শ্রাদ্ধশান্তি ঠিকমতো না হলে আত্মাটা বড় খাবি খাবে।
বুড়ি গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে চোখ বুজে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছিল। খানিক অন্ধকার, খানিক আবহু, নিক হিজিবিজি, ঝালকালি, কী সব যেন চোখের সামনে। মাথায় আজকাল অবাক অবাক চিন্তা আসে, ছবি আসে।