তুমি যাচ্ছ বাবা?
হ্যাঁ। শেষ বাস পাঁচটায়।
আজকাল তো কিছুতেই তোমাকে একটি দিন আটকে রাখতে পারি না। মুক্তির কী করবে কি ভেবেছ? বিয়ের পর তো অনেক দিন হয়ে গেল?
বলেছি তো, আরও কিছুদিন আপনাদের কাছে থাক। তারপর ভেবে দেখব।
ব্যাপারটা তো ভাল দেখাচ্ছে না। পাঁচজনে পাঁচকথা বলছে।
আপনার মেয়ের মন এখনও তৈরি হয়নি। আমাদের বেশ বড় পরিবার। মানিয়ে গুছিয়ে চলা খুব সহজ নয়। তাই মন তৈরি হোক।
পাপিয়া খুব সংকোচের সঙ্গে বলে, আসলে বড় আদরে মানুষ তো। অত কাজকর্মের মধ্যে গিয়ে পড়লে খেই হারিয়ে ফেলবে।
গোবিন্দ চিরুনিটা পকেটে খুঁজে রেখে বললে, তা বলে তো আমিও আর ঘর-জামাই থাকতে পারি না।
শাশুড়ি বিবর্ণ মুখে বলে, সেকথা কি বলেছি বাবা?
আপনার মেয়ে আমাকে আলাদা সংসার করার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেটা কোনওদিনই সম্ভব না। আমরা মা বাপকে আস্তাকুঁড়ে ফেলতে শিখিনি।
গোবিন্দর হঠাৎ খেয়াল হল, তার গলা কিন্তু সপ্তমে পৌঁছে গেছে। এবং ভেতরে ভেতরে রাগের একটা ঝড় পাকিয়ে উঠছে। সে লজ্জা পেয়ে হঠাৎ চুপ করল। গুম হয়ে গেল।
তারপর গলা কয়েক পর্দা নামিয়ে এনে বলল, আপনি আর আমাকে চিঠি লিখে আনানোর চেষ্টা করবেন না।
পাপিয়া কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর বলল, আলাদা থাকা কি ঘর-জামাই থাকা বাবা?
তার চেয়ে খুব বেশি ভালও নয়। আমার আর সময় নেই। আমি যাচ্ছি।
আমার মনটা ভাল নেই বাবা, কী বলতে হয়তে কী বলেছি। তোমার শ্বশুরকে কিন্তু ঘরজামাই থাকতে আমিই বারণ করতাম। লোভে পড়ে হল, তার প্রায়শ্চিত্ত এখনও করতে হচ্ছে।
কান্না একদম সইতে পারে না গোবিন্দ। কেউ কাঁদলেই–তা সে কপট কান্না হলেও সে কেমন দ্রব হয়ে পড়ে। পাপিয়া দরজার কপাট দুহাতে আঁকড়ে ধরে তাতে মুখ গুঁজে কাঁদছিল।
দ্রব হলেও গোবিন্দ কখনও গলেও যায় না। সে গম্ভীর নিচু গলায় বলে, আপনি কাঁদছেন কেন? কান্নাকাটি দিয়ে তো এ জট খোলা যাবে না।
পাপিয়া তার হেঁচকি মেশানো কান্নার মধ্যেই বলে, তোমরা কি ভাব ওই লোকটা খুব সুখে আছে? একমাত্র বাবা ছাড়া প্রত্যেকে ওকে দিন রাত অপমান অবহেলা করেছে। আমাদের কাছেও সম্মান পায় না। নিতান্ত বেহায়া আর লোভী বলে বিষয় আঁকড়ে পড়ে থাকে।
ওঁর কথা টেনে আনছেন কেন? আমি তো আপনার মেয়ের কথা বলছিলাম।
তুমি তো ওঁকে দুচোখে দেখতে পারো না। ও সেটা টের পায় বলেই তোমার সামনে আসে না। বোধহয় তুমি আছ বলেই চৌপর দিন কোথায় গিয়ে না খেয়ে বসে আছে।
তা হলে তো আমার না আসাই ভাল।
আমার কপাল! যা বলি তার উল্টো অর্থ হয়। আমি বলতে চেয়েছিলাম শ্বশুরকে অপছন্দ করো বলেই মুক্তিকেও তুমি সহ্য করতে পারো না।
আমি ওভাবে ভাবিনি। আপনারা যা খুশি হয় ব্যাখ্যা করতে পারেন। তবে আমার মনে হয়, চোখের জলটা আমার ওপর না খাঁটিয়ে আপনার মেয়ের ওপর খাটালে অনেক বেশি কাজ হত।
চোখের জলের কথা বলছ বাবা? আমার চোখের জল ধরে রাখলে এতদিনে সমুদ্র হয়ে যেত। বাকি জীবনটা কাঁদতে কাঁদতেই যাবে। আমি বলি কী, তুমি মুক্তিকে জোর করে নিয়ে যাও।
জোর করে মানে? চুলের মুঠি ধরে নাকি?
দরকার হলে তাই করবে। নিয়ে গিয়ে বাসন মাজাও, কাপড় কাঁচাও, ঘর মোছাও, লাথি মারো, খুন করো, তবু ওকে নিয়ে যাও।
তার মানে আমরা ওসব করি নাকি? লাথি মারি? খুনও করি?
পাপিয়া অসহায়ের মতো বিল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একরকম ছুটে পালিয়ে গেল।
একথা ঠিকই যে, গোবিন্দর একটা ক্ষ্যাপাটে রাগ আছে। সেই চরম রাগটা উঠলে তার ভেতরটা শুধু আগুন আর মাথায় মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ হতে থাকে। কিন্তু এই রাগটা আর কারও তত নয়, যতটা ক্ষতি করে তার নিজের। সে তখন কোনও কাজ করতে পারে না, ঘুমোতে পারে না, খেতে পারে না। শুধু ভেতরকার নিরুদ্ধ রাগে কাঁপতে থাকে।
সত্যিই হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল তার। একরকম টলতে টলতে মাতালের মতো সে বেরিয়ে এল বাইরে। তারপর চণ্ডীমণ্ডপ ডাইনে রেখে সোজা বাসরাস্তার দিকে হাঁটা দিল।
বাবু! বলি ও জামাইবাবু!
গোবিন্দ দাঁড়াল, পাগলটা না? সে তাকাতেই হাতছানি দিয়ে ডাকল। এখন পাগলটার কাছে কেউ নেই। ফাঁকা চণ্ডীমণ্ডপে একা বসে আছে।
যাবে না যাবেনা করেও গোবিন্দ গেল তার কাছে, কী বলছ?
কৃষ্ণকান্ত এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করে, বন্দোবস্তটা কীরকম হল? এই চণ্ডীমণ্ডপটা কি আমাকে দিয়ে দিলেন ঘরজামাই?
গোবিন্দ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, সে পাত্র পাওনি।
তা হলে কী হবে এখন?
যতদিন পারো থাকবে। দুধটুধ খাওয়াতে পারে কয়েকদিন। গাঁয়ের থেকে চাপ দিলে থেকেও যেতে পারো।
কৃষ্ণকান্ত একটু বিরস মুখে বলে, পাকা কাজ হল না। বড্ড দোটানায় পড়ে গেলুম যে। আপনি তো ঘোড়েল লোক, একটা বুদ্ধি করতে পারেন না?
আমার তত বুদ্ধি নেই।
কৃষ্ণকান্তকে ভাবিত দেখাল। বলল, সুবিধের জায়গা নয়। মজা নেই। বড্ড ভ্যাভ্যাত করছে।
তাই নাকি? তবে ইচ্ছেটা কী?
এখানে পোষাবে না। আমার বাঁকা নদীর পোলই ভাল। ঘরজামাই যদি চণ্ডীমণ্ডপটা লিখে দিতে তা হলে বেশ হত। এটা বেচে দিয়ে জিলিপি খেতুম।
গোবিন্দ একটু ম্লান হেসে বলে, চলি হে। আমার আর সময় নেই।
একটু দাঁড়ান বাবু। মাজায় বড় ব্যথা, একটু ধরে তুলবেন?
উঠে কোথায় যাবে?
একটু কষ্ট করে আমাকে পোলের কাছে পৌঁছে দিন। সরকার বাহাদুর আমার জন্যই পোলটা বানাল। আমিই দেখিশুনি কিনা।