ফাঁকা ফাঁকা কামরায় বুড়ো উসখুস করছে। মুখোমুখি আমরা বসে ঘুমের ভান করে চোখ মিটমিট করে সব দেখছি। বুড়ো চাপা গলায় বলল, এত সব গয়না-টয়না পরে বেরিয়ে ভাল কাজ করোনি। ভয়-ভয় করছে।
বুড়ি ধমক দিয়ে বলল, রাখো তো ভয়! গা থেকে গয়না খুলে রেখে আমি কোনও দিন বেরিয়েছি নাকি? ও সব আমার ধাতে সইবে না।
বুড়ি ঝাঁপি থেকে স্টিলের তৈরি ঝকঝকে পানের বাটা বের করে বসল। বাটাখানা চমৎকার। বারোটা খোপে বারো রকমের মশলা, মাঝখানে পরিষ্কার ন্যাতায় জড়ানো পানপাতা। দামি জিনিস।
পৈলেন আর হাজু গা ঝাড়া দিয়ে উঠল, আমি আর কদম কামরার দু’ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। পৈলেনের পিস্তল আছে, হাজুর ছুরি। কদম নলবন্দুক হাতে ওধার সামলাচ্ছে। কী জানি কেন, আমার হাতে ওরা অস্ত্রশস্ত্র কিছু দেয়নি। কেবল ধারালো দুটো ব্লেড আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরতে শিখিয়ে দিয়েছে হাজু, বলেছে, যখন কাউকে ব্লেড ধরা হাতে আলতো করে গালে-মুখে বুলিয়ে দিবি, তখন দেখবি কাণ্ডখানা। রক্তের স্রোত বইবে।
পৈলেন পিস্তল ধরতেই বুড়ো বলে উঠল, ওই যে দেখো গো, বলেছিলুম না! ওই দেখো, হয়ে গেল।
বুড়ি পানটা মুখে দিয়ে পৈলেনের দিকে তাকিয়ে বলল, এ মিনসেটাই ডাকাত নাকি! ওমা, এ যে একটু আগেও সামনে বসে ঝিমোচ্ছিল গো!
বুড়ো আস্তে করে বলল, এখন ঝিমুনি কেটে গেছে। সামলাও ঠ্যালা।
বুড়ি ঝংকার দিয়ে বলে ওঠে, আমি সামলাব কেন তুমি পুরুষ মানুষ সঙ্গে থাকতে? এককালে তো খুব ঠ্যাঙা-লাঠি নিয়ে আবগারির দারোগাগিরি করতে। এখন অমন মেনিমুখো হলে চলবে কেন?
পৈলেন ধৈর্য হারিয়ে বলল, অত কথার সময় নেই, চটপট করুন। আমাদের তাড়া আছে।
বুড়ি ঝংকার দিল, তাড়া আছে সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু গয়না আমি খুলছি না। তাড়া থাকলে চলে যাও।
হাজু ‘চপ’ বলে একটা পেল্লায় ধমক দিয়ে হাতের আধ-হাত দোধার ছোরাটা বুড়োর গলায় ঠেকিয়ে বলল, পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি গয়না খুলতে। যদি দেরি হয় তো এই বুড়োমানুষটার হয়ে যাবে দিদিমা। বিধবা হবেন।
বুড়ি জর্দা আটকে দু’বার হেঁচকি তুলে হঠাৎ হাউড়ে মাউড়ে করে কেঁদে উঠে চেঁচাতে লাগল, ওমা গো, ওগো তোমরা সব দেখো, কী কাণ্ড। বুড়োটাকে মেরে ফেলল যে!
কামরায় মোট জনা কুড়ি লোকও হবে না। এধার-ওধার ছিটিয়ে বসে ছিল। কেউ নড়ল না। সবাই অন্যমনস্ক হয়ে কিংবা ভয়ে পাথর হয়ে রইল। কেবল দুটো ছোকরা টিটকিরি দিল কোথা থেকে, দাদাদের কমিশন কত? একজন বলল, ও দাদা, অথরিটি কত করে নেয়? সব বন্দোবস্ত করা আছে, না?
গলায় ছোরা-ঠেকানো অবস্থায় বুড়ো তখন তম্বি করছে, কী ব্যাপার বলো তো তোমার! গা করছ না যে? পাঁচ মিনিটের আর কত বাকি আছে শুনি! শিগগির গয়না খোলো।
বুড়ি তখনও জর্দার ধক সামলাতে পারেনি। তিন-তিনটে হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল, খুলতে বললেই খুলব, না? এ সব গয়না ফের আমাকে কে তৈরি করে দেবে আগে বলো! তুমি দেবে?
দেব, দেব শিগগির খোলো। বুড়ো তাড়া দেয়।
কিন্তু বুড়ি তবু গা করে না। কষ্টেসৃষ্টে একগাছা চুড়ি ডান হাত থেকে আঙুলের গাঁট পর্যন্ত এনে বলে, সেই কবে পরেছিলুম, এখন তো মোটা হয়ে গেছি, এ কি আর খোলা সহজ?
হাজু তার ছোরাটা এগিয়ে দিয়ে পিস্তলটা পৈলেনের হাত থেকে নেয়। পৈলেন ছোরাটা চুড়ির ফাঁকে ঢুকিয়ে এক টানে কেটে নেয়। দিদিমা চেঁচাতে থাকেন ভয়ে, কিন্তু পৈলেনের হাত পাকা, কোথাও একটুও ছড়ে যায়নি। পৈলেন পটাপট চুড়িগুলো কাটতে থাকে।
দিদিমা দাদুর দিকে চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, কথা দিলে কিন্তু! সব গয়না ঠিক এ রকম তৈরি করে দিতে হবে। তখন নাকিসুরে বলতে পারবে না, এখন রিটায়ার করেছি, কোত্থেকে দেব!
দেব, দেব।
দিদিমা তখন চার দিকে তাকিয়ে লোকজনের মুখ চেয়ে বলে, শুনে রেখো তোমরা সব, সাক্ষী রইলে কিন্তু। উনি বলেছেন সব ফের গড়িয়ে দেবেন।
পৈলেন গোটা চারেক চুড়ি ততক্ষণে খুলে ফেলেছে কেটে, চমৎকার কাজ হচ্ছে। হাজু বাঁ হাত বাড়িয়ে বুড়ো লোকটার হাতঘড়ি খুলে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিল, এবার গলার কাছে পাঞ্জাবির সোনার বোতামের প্রথমটা খুলে ফেলেছে। আমার কিছু করার নেই, দাঁড়িয়ে দেখছি। বলতে কী ট্রেনের কামরায় ডাকাতির কথা বিস্তর শুনলেও চোখে কখনও দেখিনি সে দৃশ্য। তাই প্রাণভরে দেখে নিচ্ছিলাম।
বুড়ি ফের দুটো হেঁচকি তুলে বুড়োর দিকে চেয়ে বলল, পিস্তলের নল মাথায় ঠেকিয়ে বোকার মতো বসে আছ কী? বোতামটা নিজেই খুলে দাও, নইলে ও মিনসে যেভাবে বোতাম খুলছে পুরনো পাঞ্জাবিটা না ফেঁসে যায়। আর প্রেশারের বড়ি থাকলে দাও তো, খেয়ে ফেলি। মাথাটা কেমন করছে। দুটো বড়ি দিয়ো।
এ সব কথাবার্তার মাঝখানেই হঠাৎ একটা গণ্ডগোল হয়ে গেল কী করে। মাঝখানের ফাঁকা বেঞ্চিতে অনেকক্ষণ যাবৎ একটা লোক হাকুচ ময়লা একটা চাদরে আগাপাশতলা মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল। এই সব গণ্ডগোলে বোধহয় এতক্ষণে কী করে তার ঘুম ভেঙেছে। চাদরটা সরিয়ে মস্ত একটা গোলপানা মুখ তুলে লোকটা তাকাল। চোখদুটো টকটকে লাল, নাকের নীচে মস্ত ভূঁড়ো গোঁফ, গালে বিজবিজে কালো দাড়ি। লাল চোখে কয়েক পলক দৃশ্যটা দেখেই লোকটা হঠাৎ ঘুমের ধন্দভাব ঝেড়ে ফেলে তড়াক করে উঠে বসে বিকট গলায় বলে উঠল, মানকে বলে সাবাস!