আর-এক মুঠো উড়িয়ে দিই। দেখি। দোকান ছেড়ে নেমে আসছে দোকানি। হাড়কাটা গলির ভাড়াটে মেয়েরা খদ্দের ভুলে পিল পিল করে রঙিন মুখ আর তেল-সিঁদুরের ছোপ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। একটা ঠ্যাং-ভাঙা লোক টানা রিকশায় বসে মেডিকেল কলেজে যাচ্ছিল, সে হঠাৎ দু পায়ে লাফ মারল রাস্তায়।
বউবাজারের মোড় পেরিয়ে আর-এক মুঠো ওড়াই।
ট্যাক্সিওলা ট্যাক্সি থামিয়ে বলে, কী হচ্ছে বলুন তো পিছনে?
কিছু না। আপনি চলুন।
ট্যাক্সিওলা আবার গাড়ি ছাড়ে। আমি টাকা ওড়াতে থাকি। আমার পিছু পিছু কলকাতা পাগল হতে থাকে। ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি ভুলে লাফিয়ে পড়ে রাস্তায়। সিনেমা ভেঙে যায়। দোকানেবাজারে ঝাঁপ পড়তে থাকে। দাঙ্গা লেগে যায়। ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি হতে থাকে। একটা কালো পুলিশের গাড়ি ধেয়ে আসতে থাকে আমার দিকে। আমি পাত্তা দিই না। চৌরঙ্গির মোড়ে আমি মহানন্দে টাকা ছড়াই।
টাকা ওড়ে। লাট খায়। পড়ে।
আমি মুগ্ধ চোখে দেখি। ঠিক এইরকম ভাবে আমি টাকাকে দেখতে চেয়েছি বরাবর। সস্তা, সহজ, প্রচুর। দেখতে দেখতে এত মোহিত হয়ে যাই যে, আমার কিছু খেয়াল থাকে না। ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে কখন। পুলিশের গাড়ি এসে পাশে দাঁড়িয়েছে।
সিপাইজিরা যখন ধরাধরি করে গাড়িতে তুলছিল তখন কেবল আমি প্রাণপণে চেঁচিয়ে বলছিলাম, ছেড়ে দাও আমাকে। আমার বউ বসে আছে আমার জন্য। আমি তার কাছে যাব।
পিস্তলওলা এক পুলিশ সাহেব বলল, এত কালো টাকা আমি কখনও দেখিনি।
.
আমার ক’মাসের মেয়াদ হয়েছিল আমি জানি না। যখন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব রায় পড়ছিলেন তখন আমি অন্য কথা ভাবছিলাম।
কম্বলে শুয়ে আমার গায়ে বড় চুলকুনি হয়েছে, তাই খুব চুলকোচ্ছিলামও। রায় পড়া হয়ে গেলে পুলিশ আমাকে জেলে আটকে রাখল।
তারপর ছেড়েও দিল একদিন।
কোনও মানে হয় না। খামোকা এই আটকে রাখা আর ছেড়ে দেওয়া।
বেরিয়ে এসে পৃথিবীর রাস্তাঘাট কিছু অচেনা ঠেকছিল, আর-একটা লোকও ছাড়া পেয়ে সঙ্গে নিয়েছিল। পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, শালারা বোকা।
কারা?
ওই যারা আমাকে জেলে পাঠিয়েছিল। বুঝলে! আসলে খুনটা আমিই করেছিলাম। বদ্যিনাথ নয়। তা বদ্যিনাথের যাবজ্জীবন হল, আমার ছ’ মাস।
বলে খুব হাসল লোটা। বলল, কালীমায়ের থানে একটা পুজো দিই গে। তারপর গঙ্গাস্নান করে সোজা বাড়ি। তুমি কোন দিকে?
বেঁটে, কালো, মজবুত চেহারার লোকটার দিকে চেয়ে থাকি। তারপর বলি, আমার রাস্তাঘাট সব গুলিয়ে গেছে। ঠিক চিনতে পারছি না। আমি আমার বউয়ের কাছে যাব।
তা আর ভাবনা কী। চলো একসঙ্গে যাই। একদিন না একদিন ঠিক বউ এসে জুটবে তোমার।
আমি মাথা নেড়ে তার সঙ্গ ধরলাম।
লোকটা পুজো দিল, গঙ্গাস্নান করল। তারপর আমাকে নিয়ে কালীঘাট স্টেশন থেকে ট্রেন ধরল। ফের শিয়ালদায় এসে ট্রেন পালটে আর-এক ট্রেন। লোকটা যায়। আমিও যাই। বরাবরই দেখেছি একবার বেরিয়ে পড়লে কেউ-কেউ জুটে যাবেই।
পলাশি স্টেশনে নেমে অনেকখানি মাঠঘাট, খানাখন্দ পেরিয়ে হাঁটতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে বলি, ওহে বাপু, বড় যে নিয়ে যাচ্ছ, খুব খাটাবে নাকি?
লোকটা ভালমানুষি ঝেড়ে ফেলে বলে, তার মানে? কালীঘাটে খাওয়ালুম, এতগুলো গাড়িভাড়া গুনলুম, সে কি এমনি এমনি নাকি? মুখ দেখব বলে তো নয়। একটু ছিটেল লোক আছ তা বুঝতে পারছি। কিন্তু বসে খাওয়া আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। গতরখাস হয়ে বসে থাকলে ঠ্যাঙানি খাবে।
এরকমই সব হওয়ার কথা। একটা শ্বাস ফেলি। ভাবি, একদিন রাস্তাঘাট যখন সব ভেসে উঠবে চোখের সামনে, সেদিন দুনিয়ার সুন্দর একটা সহজ রাস্তা ধরে আমি যাব আমার বউয়ের কাছে। তত দিন একটু অপেক্ষা। মাথাটা পরিষ্কার হোক।
লোকটার কাজ বড় কম ছিল না। দু’বিঘে একটা চাষের জমি কুয়ো থেকে জল তুলে তুলে ভেজাতে হয়। বড় কষ্ট। আগাছা সাফ করি। উঠোন ঝাটাই। গোরুর জাবনা দিই। সারা দিন আর সময় হয়ে ওঠে না–
রাত্রিবেলা সব দিন ঘুম আসে না। বিছানা ছেড়ে উঠে চলে আসি খোলা হাওয়ায়, মাঠের মধ্যে। চার দিকে মস্ত আকাশ, পায়ের নীচে মস্ত মাটি। এই আকাশ গোটা দুনিয়াকে ঘিরে রেখেছে। এই মাটি চলে গেছে বরাবর সব মানুষের পায়ের নীচ দিয়ে। যোগ রেখেছে সকলের সঙ্গে সকলের। ভাবতে বড় ভাল লাগে।
এক-একদিন বুড়ো বিবেক এসে পাশে বসে। বলে, উপলচন্দোর, তোমাকে একটু দুঃখের গান শোনাতে ইচ্ছে করছে।
শোনাও।
কিন্তু গান গাইতে গেলেই বিবেকের বড় কাশি উঠে পড়ে। শেষ পর্যন্ত আর শোনাতে পারে না। হাঁপিয়ে উঠে বলে, কী কাণ্ড! ওঃ, কেতকীর বিয়েতে খুব খাইয়েছিল হে উপলচন্দোর। খুব। কুমড়োর একটা ছক্কা যা করেছিল!
কেতকী কি কেঁদেছিল বিবেকবাবা?
তা কাঁদবে না? মেয়েরা শ্বশুরঘরে যাওয়ার সময়ে কত কাঁদে।
কিন্তু আমার জন্যও তার কাঁদবার কথা ছিল যে!
বিবেক বলে, তা সে এক কান্নার মধ্যেই মানুষের কত কান্না মিলেমিশে থাকে। আলাদা করে কি বোঝা যায় কার জন্য কোন হিক্কাটা তুলল। তবে তোমার মাসিকে একবার বলেছিল বটে, পিসি, উপলদা এল না। তার জন্যই আমার এত ভাল বিয়ে হচ্ছে। সে কথা থাক উপলচন্দোর। তোমাকে বরং কুমড়োর ছক্কাটার কথা বলি, কী ভুরভুরে ঘিয়ের বাস, গরম মশলার সে যে কী প্রাণকাড়া গন্ধ, কাবলি ছোলা দিয়েছিল তার মধ্যে আবার।