কী আছে প্রীতি?
নতমুখী প্রীতি বলে, তুমি বড় ভাল লোক। তুমি খুব ভাল।
আমি মাথা নেড়ে বলি, না প্রীতি। আমি ভাল নই। আমার যখন খিদে পায় তখন আমার মাথার ঠিক থাকে না। তখন মানুষ আমাকে যা করতে বলে তাই করি। বরাবর মানুষ আমাকে নিমিত্তের ভাগী করেছে প্রীতি। কিন্তু যদি খিদে না পেত–
সজল, বিশাল দুখানা চোখে প্রীতি আমার দিকে তাকায়। তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। কথা ফোটে না প্রথমে। তারপর খুব অন্য রকম এক গলায় আস্তে করে বলে, আমি তোমাকে খাওয়াব উপল। আমি তোমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাব। দুজনে মিলে খাটব, খাব। খিদের কথা বোলো না। আমার বড় কষ্ট হয়।
অবাক হয়ে বলি, আমেরিকায় নিয়ে যাবে?
ও মাথা নেড়ে বলল, নিয়ে যাব। আমি সামনের রবিবারে চলে যাচ্ছি। গিয়েই তোমার যাওয়ার সব ব্যবস্থা করব। ভেবো না, সে দেশে কখনও খাবারের অভাব হয় না।
নিয়ে যাবে! আমার রক্তে রক্তে ট্যাংগো নাচের বাজনা ঢুকে যায়। আমার ভিতরে যেন এক নাচঘর তৈরি হয়ে গেল। সেই ঘরে জোড়া জোড়া পা ফেলে সাহেব-মেম নেচে বেড়াচ্ছে।
প্রীতি!
প্রীতি উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শুনবার চেষ্টা করছিল। জবাব দিল, উ!
কবে আমাদের বিয়ে হবে?
আজ। বেলা তিনটের সময় ম্যারেজ রেজিস্ট্রার আসবেন, সাক্ষীরা আসবেন।
আমি হাসলাম। বহুকাল এমন গাড়লের মতো হাসিনি।
প্রীতি, শোনো। বিয়ের পর আমরা জোড়ে মাসির কাছে যাব।
প্রীতি অবাক হয়ে বলে, মাসি কে?
আমার এক মাসি আছে। মাসি ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ নেই। বড় খুশি হবে মাসি। কত আদর করবে তোমাকে, দেখো। যাবে তো!
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাব উপল।
তুমি মাসিকে প্রণাম করবে তো প্রীতি?
করব, নিশ্চয়ই করব।
কটা বাজে প্রীতি?
প্রীতি মৃদু হেসে বলে, তিনটে বাজতে পাঁচ মিনিট। তুমি ঘাবড়ে যাওনি তো উপল?
অবাক হয়ে বলি, না তো! ঘাবড়াব কেন? আমার অসম্ভব, অসহ্য এক আনন্দ হচ্ছে। প্রীতি, তুমি বিয়ের পর সিঁদুর পরবে তো?
প্রীতি করুণ মুখখানা তুলে বলে, পরতে তো হবেই।
শাঁখা?
তাও।-বলে প্রীতি হাসল। বড় সুন্দর হাসি।
তুমি কি রাঁধতে পারো প্রীতিসোনা?
প্রীতি ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ। আমি অনেক রকম রান্না জানি। দেশি, বিলিতি। আমেরিকায় তো আমাকেই রাঁধতে হবে তোমার জন্য।
কেন প্রীতি? আমরা রান্নার লোক রাখব।
ওদের দেশে ভীষণ টাকা লাগে লোক রাখতে।
লাগুক। তোমাকে আমি তা বলে রাঁধতে দেব না।
আচ্ছা। বলে প্রীতি চোখে চোখে একটু হাসে।
সিঁড়ি দিয়ে পায়ের শব্দ উঠে আসছে। উত্তেজনায় কেঁপে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি।
প্রীতিও উঠে দাঁড়ায়। ম্লান মুখ করে বলে, ওরা আসছে।
আমি আজ দাড়ি কামাইনি প্রীতি।–গালে হাত বুলিয়ে বলি।
তাতে কিছু হবে না উপল। সারা জীবন তো কামাবেই।
সাজিনি।
তোমাকে অনেক পোশাক করে দেব।
তিনজন লোক ঘরে এসে দাঁড়ায়। একজনের হাতে খাতাপত্র। প্রথমে উত্তেজনার বশে আমি তাদের মুখ ভাল করে দেখতে পাই না। তারপর হঠাৎ খেয়াল হয়, তিনজনের মধ্যে একজন প্রীতির সেই প্রেমিক।
প্রীতি আমার কাছে ঘেঁষে এসেছিল। ওর একটা হাত কখন আমার হাতের মুঠোয় এসে গেছে। আমি ফিস ফিস করে বলি, ও কে প্রীতি? ও কেন এখানে?
প্রীতি মৃদু স্বরে বলে, ও আমার কেউ না উপল। ও শুধু সাক্ষী দিতে এসেছে।
পাশের ঘরে ট্যাংগো থামল, দরজা খুলে বেরিয়ে এল রুমা। খাতা হাতে লোকটা চেয়ার টেবিলে গিয়ে বসল। প্রীতির প্রাক্তন প্রেমিক আর একজন অচেনা লোক গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকল।
থমথম করছে ঘর। কেউ কোনও আনন্দ করছে না। এই শোকের ছায়ার মধ্যে কী করে বিয়ে হবে?
প্রীতি আমার হাত চেপে ধরে বলল, এসো উপল।
আমি বললাম, কেউ উলু দিল না প্রীতি, শাঁখ বাজল না।
প্রীতি আমাকে টেবিলের সামনে নিয়ে গেল। ম্যারেজ রেজিস্টার আঙুল দিয়ে ফর্মে একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এইখানে সই করুন।
একদম সময় লাগল না। আমি আর প্রীতি সই করার পর রুমা, প্রীতির ভূতপূর্ব প্রেমিক আর অচেনা লোকটা সই করল। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার তার খাতাপত্র গুছিয়ে নিয়ে উঠল। চলে গেল।
প্রীতি তার ঘোরানো চেয়ারে বসে আছে। নতমুখ। কালো আঙুরের থোপায় ঘিরে আছে মুখখানা। হঠাৎ ও একটু কেঁপে উঠল। চাপা কান্নার একটা অস্ফুট শব্দ কানে এল। ঘরের মাঝখান থেকে আমি ছুটে ওর কাছে যাওয়ার জন্য এগোতেই মাঝখানে রুমা এসে দাঁড়াল।
উপলবাবু! ওকে এখন আর ডিস্টার্ব করবেন না।
ডিস্টার্ব!–আমি ভীষণ অবাক হয়ে বলি, ডিস্টার্ব মানে? ও আমার বউ। আমার বউ কাঁদছে কেন সেটা আমার জানা দরকার।
রুমার দু’পাশে প্রীতির প্রাক্তন প্রেমিক আর অচেনা লোকটাও এসে দাঁড়াল। করুণ চোখে আমার দিকে চেয়ে প্রেমিকটি বলল, সে তো ঠিকই উপলবাবু। ও তো চিরকালের মতোই আপনার হয়ে গেল। এখন ওকে একটু রেস্ট নিতে দিন।
তীব্র আকুলতায় আমি বললাম, আমাকে ওর কাছে যেতে দিন। আমার বউ কাঁদছে।
রুমা অত্যন্ত উদাস গলায় বলল, উপলবাবু, এখনও ও কেবলমাত্র কাগজের বউ। সেটাই আপনার পক্ষে যথেষ্ট হওয়া উচিত।
ভীষণ অবাক হয়ে বলি, কাগজের বউ! তার মানে?
কাগজে সই করা বউ। রুমা নিষ্ঠুর গলায় বলে, তার বেশি নয়।
আমি গাড়লের মতো তাকিয়ে থাকি। তিনজন মানুষ আমার সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওপাশে প্রীতি তার টেবিলে মাথা রেখে কাঁদে অঝোরে।