তাই টাকার জন্য আমার দিদিকে নষ্ট করলেন?
নষ্ট?
বলে আমি অবাক হয়ে তাকাই। তারপর প্রীতির কাছে হামাগুড়ি দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে বলি, দেখুন। আমার মুখের মধ্যে দেখুন।
এই বলে হাঁ করে থাকি।
প্রীতি আমাকে পাগল ভেবে উঠে দাঁড়ায়। বলে, কী দেখব?
দেখলেন না আমার মুখের মধ্যে?
কী?
বিশ্বরূপ। শ্রীকৃষ্ণ দেখিয়েছিলেন অর্জুনকে। আপনিও ভাল করে দেখলে দেখতে পেতেন, আমি কাউকে নষ্ট করিনি। যে যার কর্মফলে নষ্ট হয়ে আছে। আমি নিমিত্ত মাত্র।
লোকে যেমন রাস্তার পাশে পচা ইঁদুর দেখে তেমনি একরকম ঘেন্নার চোখে আমাকে দেখছিল প্রীতি। অনেকক্ষণ দেখে বলল, আপনি অন্য কোথাও যেতে চান না উপলবাবু?
গেঞ্জিটা ধুয়ে নিংড়ে আমি উঠে আসি। হেসে বলি, যাব। আমাকে তো যেতেই হবে। প্রীতি, জীবনে এই প্রথম একটা কাজ আমি সম্পূর্ণ করেছি। এই আনন্দটা আমাকে কিছুক্ষণ উপভোগ করতে দিন।
কী কাজ?
ক্ষণাকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছি। এবার আপনারা আমেরিকা চলে যেতে পারবেন।
বেচারা!– প্রীতির দীর্ঘশ্বাস ফাঁকা বাড়িতে বড় করে শোনাল। বলল, আপনি কি ভাবেন, যে লোকটা তার বউকে স্ক্যান্ডালে জড়ানোর জন্য এত কাণ্ড করছে তাকে আমি বিশ্বাস করব? ক্ষণাদিকে আমরা ছেলেবেলা থেকে জানি। চিরকাল ওর ঘর-সংসারের দিকে ঝোঁক। এমন গুছিয়ে পুতুল খেলত যে সবাই বলত, ও খুব সংসার-গোছানি মেয়ে হবে। তাই হয়েছিল ক্ষণাদি। স্বামী, শাশুড়ি, বাচ্চা সংসার নিয়ে কেমন জড়িয়ে গিয়েছিল। অমন ভাল বউকে কেউ এত নীচে টেনে নামায়?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই।
প্রীতি আমার একটা হাতে হাত রেখে বলল, কেন করলেন এমন? কী দিয়ে ভোলালেন ক্ষণাদিকে?
উদাস স্বরে বলি, আমি নিমিত্ত মাত্র। যা হওয়ার তা হয়েই ছিল।
প্রীতি আরও এক পা কাছে সরে এসে বলল, কিছু হয়নি উপলবাবু। জামাইবাবুকে আমি নিইনি মনের মধ্যে। কখনও হয়তো কোনও দুর্বলতা এসেছিল, এখন নেই। আপনি দিদিকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
কোথায় প্রীতি?
আপনাকে আমার ভীষণ দরকার।
কেন প্রীতি?
বলব। আপনি আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন।
গোছানোর মতো কিছু নেই।
তা হলে চলুন।
আমি পোশাক পরে নিই। টাকার মস্ত বান্ডিলটা পকেটে পুরি।
প্রীতি আড়চোখে দেখে বলল, কত টাকা!
অনেক।
প্রীতি চেয়ে রইল আমার দিকে। করুণাঘন চোখ।
ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিল প্রীতি। উঠতে গিয়েই চমকে উঠে দেখি, রুমা বসে আছে। পিছনের সিটে হেলে বসে নিজের বাঁ হাতের নখগুলো দেখছিল। আমার দিকে খরচোখে একবার তাকাল। প্রীতিকে বলল, ওঁকে সব বলেছ প্রীতি?
না। তুমি বলো।
বলছি।
বলে রুমা সিটের মাঝখানে সরে এসে বসল। এক ধারে প্রীতি, অন্য ধারে আমি।
ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। পাঞ্জাবি ট্যাক্সিওয়ালা ধীরগতিতে গাড়ি চালায়। হয়তো তাকে ও রকমই নির্দেশ দেওয়া আছে।
রুমা পাশে বসতেই আমার শরীরে একটা কাঠের মতো শক্ত ভাব দেখা দিল। বুকে ভয়। নার্ভাস লাগছে।
রুমা আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, শুনুন রোমিও, প্রীতি অবশেষে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।
আমি অনেকখানি বাতাস গিলে ফেলি।
আমাকে?
আপনাকে। কেন, আপনি রাজি নন?
উদভ্রান্তের মতো বলি, কী বলছেন? আমি কি ঠিক শুনছি?
ঠিকই শুনছেন। প্রীতি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে। আজই এক্ষুনি। অনেক স্যুটারের ভিতর থেকে প্রীতি আপনাকেই বেছে নিয়েছে। আপনি ভাগ্যবান।
মাথাটা ঘুলিয়ে ওঠে। কিছু বুঝতে পারি না। পাঞ্জাবি ট্যাক্সি ড্রাইভারের সবুজ পাগড়ির দিকে চেয়ে থাকি। আমার শরীরের কোথায় যেন একটা বৈদ্যুতিক তার ছুঁয়ে আছে। মৃদু শিহরনে শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। নতুন এক চোখে প্রীতির দিকে পাশ ফিরে চাইলাম।
প্রীতি আমার দিকে চেয়ে ছিল, চোখ চোখ পড়তেই মুখখানা ঘুরিয়ে নিল বাইরের দিকে।
গোলপার্কে ওদের ফ্ল্যাটে এসে রুমা বলল, আমি পাশের ঘরে আছি প্রীতি। তোমরা কথা বলে নাও।
রুমা তার ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকানি দিয়ে দিল। তারপর ও ঘর থেকে সেই ট্যাংগো নাচের বাজনা আসতে লাগল।
তার সেই ঘোরানো চেয়ারে প্রীতি মাথা নত করে বসে আছে। কার্ল করা খাটো চুলের রাশি থোপা থোপা কালো আঙুরের মতো ঘিরে আছে মুখখানা।
গদি-আঁটা টুলের ওপর হতভম্ব মাথা নিয়ে বসে আছি। কথা আসছে না।
অনেকক্ষণ বাদে প্রতি তার সুন্দর কিন্তু ফ্যাকাসে মুখখানা তুলে আমার দিকে ফেরাল। নরম আদরের গলায় ডাকল, উপল!
উ।
আমাকে বিয়ে করবে না উপল?
মাথা নেড়ে বললাম, আমি কি স্বপ্ন দেখছি প্রীতি?
না।–প্রীতি মাথা নেড়ে বলল, শোনো উপল, তোমাকে ছাড়া আমার উপায় নেই।
চোখের জল মুছে নিয়ে বললাম, আমাকে কেউ ভালবাসে না প্রীতি।
প্রীতি আবার কালো আঙুরের থোপায় মুখ ঢেকে মাথা নত করে মৃদু স্বরে বলল, আমি বাসি।
কবে থেকে প্রীতি?
যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম। জামাইবাবুর পাগলামির চিঠি নিয়ে এসেছিলে। আমি তোমার ওপর বিরক্ত হয়েছিলাম উপল। কিন্তু তখন থেকেই তোমাকে ভুলতে পারি না। কেন ভুলতে পারি না তা অনেক বার ভেবে দেখেছি, বিরক্ত হয়েছি নিজের ওপর। পরে বুঝতে পেরেছি, তোমাকে আমি কবে থেকে যেন ভালবেসে ফেলেছি! বুঝে নিজের ওপর রেগে গেছি। কিন্তু ভালবাসার ওপর কি কারও হাত থাকে, বলো!
প্রীতি, আমি সামান্য মানুষ।
কে বলল উপল? তুমি সামান্য নও। তোমার ভিতরে কী আছে তা তুমি কোনও দিন বুঝতে পারোনি।