হুইস্কির আধ গেলাস টেনে নিয়ে তীব্র অ্যালকোহলের যন্ত্রণায় গলা চেপে বুম হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর আলোছায়াময় মুখ তুলে অদ্ভুত হেসে বলল, ইউ হ্যাভ ডান ইট বাডি। কংগ্রাচুলেশনস।
আমি উঠতে যাচ্ছিলাম। যখন দরজার কাছ বরাবর পৌঁছে গেছি তখন ও ডেকে বলল, ইউ নো সামথিং বাডি, ইউ আর ইন লাভ উইথ হার। গোয়িং টু ম্যারি হার বাডি, হোয়েন আ’ল বি অ্যাওয়ে ফ্রম হিয়ার?
আমি চুপ করে রইলাম। তারপর মাথা নাড়ালাম। না।
লাভ হার বাডি। প্লিজ।
আমি ওর দিকে তাকালাম। স্পষ্ট টের পাই, আমার চোখ বাঘের মতো জ্বলছে। সমস্ত গায়ে শিরশির করে উঠছে রাগ। কিন্তু মাতাল সুবিনয় আমাকে লক্ষই করল না। বলল, আই অ্যাম গোয়িং হোম টুনাইট। ওয়েট বাডি, আই ক্যান টেক ইউ হোম।
.
রাতে আমি ফের বারান্দায় শুয়েছি। প্যাকিং বাক্সগুলি একটু নড়বড় করে বিছানাটা বড্ড শক্ত আর স্যাঁতস্যাঁতে ঠেকে। এ সবই ক’দিন সুবিনয়ের পুরু গভীর বিছানায় শোওয়ার অভ্যাসের ফল। শুয়ে জেগে থাকি। সুবিনয়ের ঘর থেকে কোনও শব্দ আসে না। ওরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে।
কাত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখি। ক্ষয়া একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। বড় ভাল লাগে। চেয়ে থাকি। ভিতরটা বিস্বাদে ভরে আছে। চাঁদ বড় ভাল লাগে। চাঁদ কোনও কাজে লাগে না, ব্যবহার হয় না। শুধু অকারণে আকাশে ঝুলে থাকে। চাঁদ তাই বড় ভাল।
বুড়ো বিবেক আমার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, পাপ হল লঙ্কার মতো। যেমন ঝাল তেমনি স্বাদ। না উপল?
হ্যাঁ বিবেকবাবা।
কাঁদছ নাকি?
না বিবেকবাবা। চেষ্টা করে দেখেছি, আজকাল কান্না আসে না।
বিবেক শ্বাস ফেলে বলে, কাঁদলে ভাল লাগত।
জানি। কিন্তু সব সময়ে কি আসে?
বিবেক শ্বাস ফেলে বলে, পেটে অম্বল জমলে যেমন বমি করলে আরাম হয়, কান্নাও তেমনি। তোমার কোনও দুঃখের কথা মনে পড়ে না? কিছু একটা মনে করে দেখো। কান্না এসে যাবেখন।
আসে না। আমি মাথা নেড়ে বলি, অনেক দিন বাদে এই প্রথম একটা কাজ আমি শেষ করেছি বিবেকবাবা। মেলা ঝামেলা কোরো না। তুমি যাও।
বিবেক চলে যায়।
সে যেতে না যেতেই ছুঁচোর চিড়িক ডাক আসে অন্ধকার বারান্দার কোথা থেকে যেন। চমকে উঠে বসি। বহুকাল কি ছুঁচোটা আসেনি? না কি আমিই লক্ষ করিনি ওকে, নিজের অন্যমনস্কতায় ড়ুবেছিলাম বলে ওর ডাক কানে আসেনি?
চকিতে মনে পড়ল, বিষ আনতে বার বার ভুল হয় বলে ক্ষণা আজ নিজেই কিনে এনেছে। শোওয়ার আগে আটার গুলিতে বিষ মাখিয়ে বারান্দায় আর বাথরুমে ছড়াচ্ছিল। আর তখন একবার আমার খুব কাছে এসে চাপা স্বরে বলেছিল, ও এসেছে। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে কী করে যে আর একটা রাতও থাকব! পারছি না, একদম পারছি না। তুমি আমার কী করলে বলো তো! আমি কি নষ্ট হয়ে গেলাম? এ কি ভাল হল?
আমি উঠে বাতি জ্বালি। মুখ ধোওয়ার বেসিনের নীচে এঁটো বাসনের ওপর ছুঁচোটা তুরতুর করছে। আমাকে দেখে মুখ তুলল। দুটো চোখ আলোয় আলোময়। ওর অল্প দূরেই সেই বিষ মাখানো আটার গুলি। আমি নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিই।
লোভে আমার পায়ের কাছে ছুটে আসে ছুঁচোটা। করুণ মুখ তুলে যেন বলে, দাও। বড় খিদে।
আমি তাকে পাত্তা দিই না। তড়িৎগতিতে আমি বারান্দা আর বাথরুম থেকে আটার গুলি তুলে নিতে থাকি। ছুঁচোটা আমাকে আর ভয় পায় না। পায়ে পায়ে ঘোরে আর ডাকে। চিড়িক স্বরে যেন বলে, দাও। আমার বড় খিদে। আমাদের দর্শন-বিজ্ঞান নেই, সুখ-দুঃখ নেই, প্রেম-ভালবাসা নেই। আছে শুধু খিদে দাও।
আমি হাঁটু গেড়ে তার মুখোমুখি বসে বলি, আমিও কি নই তোমাদের মতো? সব কিছু খেতে নেই। আমারও চারধারে কত বিষ মাখানো খাবার ছড়িয়ে রেখেছে কে যেন। মাঝে মাঝে খেয়ে ফেলি। বড় জ্বালা।
.
১৩.
সুবিনয় অফিসে গেল। ক্ষণা গেল মার্কেটিং-এ। সুবিনয়ের মা কুসুমকে নিয়ে কালীঘাটে।
আমি বাথরুমে বসে নিবিষ্ট মনে গেঞ্জি কাচছিলাম। আজকাল ক্ষণা কাচাকাচি করতে দেখলে রাগ করে বলে, তুমি কাচবে কেন? কুসুম দেবে’খন। না হয় তো আমি দেব। পুরুষ মানুষের কাজ নাকি এ সব!
গেঞ্জি কাচা আমার খুব পছন্দের কাজ নয়। কিন্তু ভাবি, সারা জীবন আমাকেই তো কাচতে হবে। আমার তো কোনও দিন বউ হবে না। মধু গুপ্ত লেনের রুস্তমদের টাকা আমি মিটিয়ে দেব। কেতকীর বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। সেই ইঞ্জিনিয়ার। তাই ভাবি, এত কাল পর কেন এই আদরটুকু নিই? আমার এমনিই যাবে।
বাথরুমের দরজায় কে এসে দাঁড়াল। প্রথমে তাকাইনি। কিন্তু নিথর এক মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে টের পেয়ে চোখ তুলেই চমকে উঠি।
প্রীতি — আমার গলার স্বর কেঁপে যায়।
সাদা খোলের চওড়া জরিপেড়ে একটা ভীষণ দামি শাড়ি পরনে। ওর মুখও সাদা। ঠোঁট ফ্যাকাসে। খুব বিষন্ন দেখাচ্ছিল।
ও চৌকাঠের কাছে এগিয়ে এসে বলল, আমি আপনার কাছেই এসেছি।
আমার কাছে?
উপলবাবু, ক্ষণাদিকে নষ্ট করলেন?
আমি মাথা নিচু করে বলি, না তো। আমি ওকে ভালবাসি।
প্রীতি জলময় নোংরা চৌকাঠের ওপর সাদা শাড়ির কথা ভুলে গিয়ে বসে পড়ল ঝুপ করে। ঠিক আমার চোখে চোখ রেখে চেয়ে রইল।
কী হল?–আমি অবাক হয়ে বলি।
আমি সব জানি উপলবাবু।
আমি মাথা নিচু করে বললাম, মাইরি।
বেচারা! প্রীতি হেসে বলে, না, ক্ষণাদিকে নয়, আপনি বড় বেশি টাকা ভালবাসেন।
আমি মাথা নেড়ে বলি, না। আমি টাকা ভালবাসি না। আমি শুধু চেয়েছিলাম টাকা সহজলভ্য হোক! বৃষ্টির মতো, জলপ্রপাতের মতো টাকা ঝরে পড়ুক। হ্যান্ডবিলের মতো টাকা বিলি হোক রাস্তায় রাস্তায়।