বুকের কাছে ঘনিষ্ঠ ক্ষণা। আমি ভাল এক্সপোজারের জন্য বর্ষাতিটা গা থেকে ফেলে দিই। তারপর গাছের ছায়ায় গভীর অন্ধকার নির্জনে ওকে জড়িয়ে ধরি। বাধা দেওয়ার কথা নয়। দিলও না ক্ষণা। আমার বিবেক এই অবস্থায় সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু আড়াল থেকে তার ঘন ঘন কাশির আওয়াজ শুনতে পাই। আমাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য সে কয়েক বার তার বাদ্যযন্ত্রটা বাজাল। আমি পাত্তা দিলাম না। আমি ক্ষণাকে যথেষ্ট, যত দূর সম্ভব আবেগে চুমু খাই। কষ্টকর, ভয়ের চুমু। আমি তো জানি আমরা একা নই। জানি, ক্ষণার স্বামীও দৃশ্যটা দেখছে। বড় বিস্বাদ চুমু। তবু ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে অপেক্ষা করছি ফ্ল্যাশগানের ঝলকটার জন্য। অপেক্ষা করছি। অনন্ত সময় বয়ে যাচ্ছে।
চমকাল। ফ্ল্যাশের আলো নীল বিদ্যুতের মতো ঝলসে দিয়ে গেল আমাদের। পর পর দুবার।
ক্ষণা চমকে চোখ চেয়ে বলে, কী গো?
বিদ্যুৎ।
ও।
আবার সংলগ্ন হই। দক্ষ লোকদের হাতে ক্যামেরা আরও একটু পর পর চমকে চমকে উঠল।
তটস্থ ক্ষণা সোজা হয়ে বসে বলে, কে টর্চ ফেলছে?
টর্চ নয় ক্ষণা। আকাশে মেঘ চমকাল।
ক্ষণা আমার দিকে চেয়ে অন্ধকারে একটু চুপ করে বসে থাকে। হঠাৎ বলে, শোনো, মনে হচ্ছে কারা যেন লুকিয়ে থেকে দেখছে আমাদের।
আমার টেপরেকর্ডারের ক্যাসেট শেষ হয়ে আসছে। আমি হঠাৎ ওকে কাছে টেনে বলি, কেউ নয়। লেক হচ্ছে মুক্ত অঞ্চল, সবাই প্রেম করতে আসে। কে কাকে দেখবে? শোনো ক্ষণা, তুমি সুবিনয়কে ডিভোর্স করবে?
ক্ষণা নিজের চুল ঠিক করছিল। একটু চনমনে হয়ে চার দিকে তাকাচ্ছে। বিপদ। আমি ওকে টেনে নিই কাছে। ও বাধা দেয় না। বরং চোখ বুজে থাকে। অস্ফুট গলায় বলে, আমাকে বহুকাল কেউ আদর করে না উপল। একটু আদরের জন্য আমার ভিতরটা মরুভূমি হয়ে থাকে।
আমার রেকর্ডারের ফিতে ফুরিয়ে আসছে। সময় নেই।
বলি, বলো ক্ষণা, সুবিনয়কে ডিভোর্স করবে?
তেমনি অস্ফুট গলায় ও বলে, তুমি কি আমাকে একেবারে চাও?
চাই।
ভালবাসবে আমাকে চিরকাল?
বাসব ক্ষণা। বললা, ডিভোর্স করবে?
ও যদি বাধা দেয়! যদি মারে তোমাকে?
মারবে না ক্ষণা। ও আমাকে ভয় পায়। বাধা ও দেবে না।
ঠিক জানো?
হ্যাঁ।
আমার ছেলেমেয়ে কার কাছে থাকবে?
আমাদের কাছে।
তা হলে করব ডিভোর্স।
কথা দিলে?
দিলাম।
আদরের ছলে আমি ওকে ফের চুমু খেতে খেতে শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসি। অন্য হাতে ওর চোখ চেপে রেখে বলি, দেখো না। আমাকে দেখো না।
সামনে থেকে, পিছন থেকে, পাশ থেকে আরও তিন বার ক্যামেরার আলো ঝলসায়। অন্ধকারে ছায়া-ছায়া মূর্তি ঝোপের আড়ালে সরে যায়। আবার অন্য দুটো ছায়া দৌড়ে এক ধার থেকে অন্য ধারে সরে গেল। ফ্ল্যাশ চমকাল ফের। ক্ষণার শরীরের ঠিক কোথায় আমার হাত রয়েছে তার নির্ভুল ছবি তুলে নিল।
ক্ষণা বলল, চোখ ছাড়ো। কী করছ?
আমার সর্বাঙ্গে ঘাম। বুকের ভিতরে অসম্ভব দাপাদাপি। হাত-পা অবসাদে খিল ধরে আসে। বর্ষাতির পকেটে টেপ-রেকর্ডার থেমে গেছে। ক্যাসেট শেষ।
আমি দাঁড়িয়ে বললাম, চলো ক্ষণা।
বোসো আর-একটু। আমার তো সিনেমার শো ভাঙার পরে ফিরলেও চলবে। কী সুন্দর দিন ছিল আজ, ফুরিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে না।
লজ্জা, ভয়, ক্লান্তি ও অনিচ্ছায় আমার মাথাটা বেভুল লাগে। আর বসে থাকার মানে হয় না। ক্লান্তির বোঝা বাড়বে কেবল।
তবু অনিচ্ছায় বসে থাকতে হয়।
ক্ষণা বলল, তুমি আমাকে খুব ভালবাসো। আমাকে, দোলনাকে, ঘুপটুকে। ওরা তো অবোধ।
আমার ভিতরকার অনিচ্ছার ভাবটা ঠেলে আসে গলায়। বমির মতো। আমি যতটুকু করার করেছি। টেপ শেষ হয়ে গেছে। ক্যামেরা নিয়ে সরে গেছে লোকজন। এখন আর প্রেমের কথা আসে না। ফাঁকা লাগে, নিরর্থক লাগে।
.
রাত্রে সুবিনয় টেপ শুনছিল। তেমনি আধখানা ছায়া, আধখানা আলোয় পাথুরে মুখ দেখা যাচ্ছে। তবে ওর মুখে আজকাল অনেকগুলি নতুন গভীর রেখা পড়েছে। টেপ শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে ঘাড় এলিয়ে দিচ্ছে। আবার সোজা হয়ে বসছে কখনও। অস্থির। সিগারেট খানিক খেয়েই প্রায় আস্ত গুজে দিচ্ছে আশট্রেতে।
আস্তে আস্তে ঘুরে টেপ শেষ হয়। সুবিনয় নিঃশব্দে উঠে ওয়াল ক্যাবিনেট খুলে নীট হুইস্কি ঢক ঢক করে জলের মতো তিন-চার ঢোক খেয়ে একটা হেঁচকি তুলল।
খুব আস্তে মড়ার মতো একখানা মুখ ফেরাল আমার দিকে। দু’চোখে একটা অনিশ্চয়তার ভাব। যেন বা ভয়।
খুব আস্তে করে বলল, ইউ নো সামথিং বাডি? ইউ আর এ বর্ন লেডি-কিলার। এ ডেমন! এ ড্রাগন!
চুপ করে থাকি। সুবিনয়ের দিক থেকে একটা মস্ত মোটা আর ভারী নোটের বান্ডিল উড়ে এসে কোলে পড়ল।
ফাইভ থাউজ্যান্ড। ইউ হ্যাভ আর্নড ইট।
এ কথা যখন বলছিল সুবিনয় তখন ওর গলায় কোনও আত্মবিশ্বাস ছিল না। ভয় পাওয়া মানুষের মতো গলা।
মাথা নিচু করে টাকাটার দিকে চেয়ে থাকি। অনেক টাকা। দারিদ্র্যের মুক্তিপণ।
সুবিনয় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে ছিল। আমার দিকে চাইছে না। সেইভাবেই থেকে বলল, আই ডোন্ট বিলিভ ইট। ইয়েট দি ইম্পসিবল হ্যাজ হ্যাপেনড বাডি।
আমি টাকা থেকে মুখ তুললাম।
সুবিনয় এসে সোফায় তার প্রিয় চিতপাত ভঙ্গিতে বসল। নিজের সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে আচ্ছন্ন করে ফেলে বলল, আমার ধারণা ছিল, ক্ষণা আমার সঙ্গে পুলটিশের মতো সেঁটে গেছে। কখনও ওকে সরানো যাবে না। অ্যাডামেন্ট ওয়াইফ।