ঘরের আলোয় দরজার চৌখুপিতে ক্ষণা ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে অন্ধকারে বারান্দাটা একটু দেখে নিয়ে সাবধানে ডাকল, উপলবাবু।
ক্ষীণ উত্তর দিলাম, উ!
আপনি কোথায়?
এই তো।
ক্ষণা বারান্দার আলো জ্বেলে আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, এ কী! ছাঁট আসছে না কি!
মৃদু হেসে বললাম, ও কিছু নয়। বৃষ্টি থেমে যাবে।
ক্ষণা হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে বারান্দার বৃষ্টির ঝাপটা দেখল, আমার বিছানায় একবার হাত ছুঁইয়েই বলল, এ মা! বিছানাটা ভিজে গেছে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, একটু।
একটু নয়, ভীষণ ভিজে গেছে। এ বিছানায় কেউ শুতে পারে না।
এ কথার উত্তর হয় না। চুপ করে থাকি।
ক্ষণা খুব সহজভাবে বলল, আপনার বন্ধুর বিছানা তো খালি পড়ে আছে, আপনি ঘরে এসে শোন। আমি আমার শাশুড়ির ঘরে যাচ্ছি।
কেঁপে উঠে বলি, কী দরকার!
আসুন না!
সন্তর্পণে উঠে আলো-জ্বলা ঘরের উষ্ণতায় চলে আসি। বগলে বিছানা। কাঁধের ব্যাগে গুপ্ত টেপ-রেকর্ডার। সুইচ টিপে রেকর্ডার চালু করি। ঠিক এ রকমটাই কি সুবিনয় চেয়েছিল? ওর ইচ্ছাপূরণ করতেই কি বৃষ্টি নামল আজ!
ক্ষণা দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ও এত বড় চাকরি করে, তবু এই বিচ্ছিরি বাসায় যে কেন থাকা আমাদের বুঝি না। একটা এক্সট্রা ঘর না থাকলে কি হয়! ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আসছে যাচ্ছে। কেন এ বাসা ছাড়ে না বলুন তো?
ছাড়বে।–সংক্ষেপে বললাম।
ছাড়বে, আমি মরলে।
ক্ষণা সুবিনয়ের শূন্য বিছানার স্ট্যান্ডে দ্রুত হাতে মশারি টাঙিয়ে দিল। তারপর নিজের বিছানা থেকে বালিশ আর ঘুমন্ত ঘুপটুকে কোলে নিয়ে বলল, দোলন রইল।
থাক।
আসছি। বলে ও ঘরে গেল ক্ষণা। আলো জ্বালাল। শাশুড়ির সঙ্গে কী একটু কথা বলল সংক্ষেপে। আবার এসে দোলনের পাশে বালিশ ঠেস দিয়ে বলল, বড় ছটফট করে মেয়েটা। পাশ ফিরতে গিয়ে পড়ে না যায়।
ক্ষণা?–আমি ডাকলাম।
বলুন।
এত কাণ্ড না করলেই চলত না? আমি তো বরাবর বারান্দায় শুই। শীতে, বর্ষায়।
ক্ষণা হঠাৎ সোজা হয়ে আমার দিকে তাকাল। মুখখানা লজ্জায় মাখানো। আস্তে করে বলল, দোষ কি শুধু আমার? আপনার বন্ধু কেন এইটুকু ছোট্ট বাসায় থাকে?
বাসাটা ছোট নয়। আমি জানি, ইচ্ছে করলে বাইরের ঘরের মেঝেতেও ওরা আমাকে শুতে বলতে পারত। বলেনি। আর আজ কত আদর করে বাড়ির কর্তার বিছানা ছেড়ে দিচ্ছে আমাকে। আমি হেসে বললাম, তবে কি আমি থাকব বলেই তোমাদের একটা বড় বাসা দরকার ক্ষণা?
শুধু সেজন্যই নয়। কত জিনিসপত্রে ঠাসাঠাসি আমাদের ঘর দেখছেন না? বাচ্চাদের একটা পড়াশুনো করার ঘর নেই।
এগুলো কাজের কথা নয়। আমি বললাম, আমার তো এ বাড়িতে থাকবার কথা নয়। অনেক দিন হয়ে গেল। তুমি কষ্ট করছ দেখে মনে হচ্ছে, আর এখানে আমার থাকা ঠিক হচ্ছে না।
ক্ষণা মৃদু হেসে বলল, থাক, এত রাতে আর কাব্য করতে হবে না। ঘুমোন।
ক্ষণা, আমার ধারণা ছিল তুমি আমাকে একদম দেখতে পারো না। তোমাকে ভীষণ অহংকারী বলে মনে হত।
ক্ষণা একটু ইতস্তত করে বলল, আপনাকেও আমার অন্য রকম মনে হত যে।
কীরকম?
মনে হত, আপনি ভীষণ কুঁড়ে।
এখন?
এখন অন্য রকম।
কীরকম ক্ষণা?
খুব মজার লোক। বলে ক্ষণা হাসল। বেশ হাসিটি। চমৎকার দেখাল ওকে।
কবে থেকে?
যেদিন সেই হনুমানের নাচ দেখিয়েছিলেন। ও মা, আমি তো দেখে অবাক! ওইরকম একটা ভিতু গোছের লোক যে অমন কাণ্ড করতে পারে ধারণাই ছিল না।
আমি কি কেবলই মজার লোক?
ভীষণ মজার।
করুণ মুখ করে বলি, তার মানে কি আমার ব্যক্তিত্ব নেই?
ক্ষণা হাই তুলে বলল, পরে বলব।
চলে গেল।
৩. টাকার ব্যাপারে
১১.
টাকার ব্যাপারে আমার কাউকে তেমন বিশ্বাস হয় না। না ব্যাঙ্ক, না পোস্ট অফিস। আমার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হল মাসি।
মধু গুপ্ত লেন-এর বাড়ির সামনে দুটো রকে আজ বড় তরফ বা ছোট তরফের কেউ ছিল না। কিন্তু ছোট তরফের রকে গুটি চারেক ছোকরা ছেলে বসে আছে।
বড় তরফের সদরে ঢুকবার মুখে ছেলেগুলোর একজন আমাকে ডাকল, এই যে মোসাই, শুনুন।
নানা চিন্তায় মাথাটা অন্য রকম। ডাকটাও কেমন যেন। শরীরটা কেঁপে গেল।
দু পা এগিয়ে বললাম, কী?
যে ছেলেটা ডেকেছিল তার মুখখানার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারি, এ ছোকরা বিস্তর পাপ করেছে। মুখে কাটাকুটির অনেক দাগ, শক্ত ধরনের চেহারা, চোখ দুটোয় একটা অস্বাভাবিক উজ্জ্বল দৃষ্টি। তার বাঁ হাতটার বুড়ো আঙুল বাদে আর চারটে আঙুল নিশ্চিহ্ন। আঙুলহীন হাতের চেটোটা খুন্তির ডগার মতো দেখাচ্ছে। সেই আঙুলহারা হাতের চেটোয় খুব কর্তৃত্বের একটু হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল।
কাছে যেতেই বলল, কোথায় যাচ্ছিলেন?
গিরিবাবুর বাড়িতে।
গিরিবাবু কে হয় আপনার?
আত্মীয়।
কীরকম আত্মীয়?
ভড়কে গিয়েছিলাম। আত্মীয়তাটা মনে করতে একটু সময় লাগল। তারপর বললাম, সম্পর্কে মামা।
অন্য একটা ছেলে ওপাশ থেকে বলল, ছেড়ে দে সমীর। আসে মাঝে মাঝে। রিলেটিভিটি আছে। যান দাদা, ঢুকে পড়ুন।
কিছু বুঝতে পারলাম না। কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই হঠাৎ কপাটের আড়াল থেকে গামছা-পরা খালি গায়ে গিরিবাবু বেরিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে ভিতরবাগে টেনে নিয়ে যেতে যেতে চাপা গলায় বললেন, কী বলল ওরা বলো তো?
আমি কে জিজ্ঞেস করছিল। অবাক হয়ে বলি, কী হয়েছে মামা?
আর বলো কেন উপল ভাগনে, আমাদের বড় বিপদ চলছে। বাড়ির বাইরে বেরোনোই এখন মুশকিল। কেউ এলে তারও বিপদ।