আমি ভিউ ফাইন্ডারে ক্ষণাকে খুব যত্নে ফোকাস করছিলাম। ওর বাঁ দিকে একটু জায়গা ছেড়ে দিলাম যাতে আমার ছবি কাটা না পড়ে যায়। বেশ খানিকটা দূর থেকে তুলছি, কাটা পড়বে না। তবু ভয়।
ও ছেলেমানুষের মতো ক্যামেরার জন্য হাত বাড়িয়ে আছে। হাসি মুখে বলছে, আমি অবশ্য আনাড়ি। আপনি সব যন্ত্রপাতি ঠিক করে দিন, আমি শুধু শাটার টিপব।
হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি চিড়িক দিয়ে উঠল। ক্যামেরায় যে সেলফ টাইমার আছে তা ক্ষণার জানার কথা নয়। পৃথিবীর খুব বেশি কিছু জানা নেই ক্ষণার। আমি শাটার টিপে উঠে গিয়ে ওর পাশে বসলে ও হয়তো টেরও পাবে না যে ছবি উঠল।
কিন্তু অসম্ভব নার্ভাস লাগছিল শেম মুহূর্তে। পারব তো! ক্ষণা কিছু সন্দেহ করবে না তো!
ভাবতে ভাবতেই শাটারটা টিপে দিলাম। চিড় চিড় করে টাইমার চলতে শুরু করে। আমি দ্রুত পায়ে জমিটা পার হয়ে ক্ষণার কাছে চলে আসি।
কিন্তু সময়টা ঠিকমতো হিসেব করা হয়নি। যে মুহূর্তে আমি ক্ষণার পাশে এসে হুমড়ি খেয়ে বসেছি ঠিক সেই সময়ে দোলন আধখানা কেক হাতে দৌড়ে এসে ক্ষণার ঘাড়ের ওপর উপুড় হয়ে কানে কানে বলল, মা। বাথরুমে যাব।
টাইমারের শেষ ক্লিক শব্দটা শুনতে পেলাম। হতাশা।
ক্ষণা উঠে গিয়ে দোলনকে বাথরুম করিয়ে আনল। ততক্ষণে আমি ক্যামেরাটা আবার তৈরি করে রেখেছি।
ক্ষণা এসে ঘাসের ওপর রাখা ব্যাগ, টিফিন বাক্সর পাশে তার আগের জায়গায় বসল। কিন্তু এবার তার কোলে এসে বসল ঘুপটু। অসম্ভব অধৈর্য বোধ করতে থাকি।
দোলন জলের ধারে গিয়ে হাঁস দেখে। ঘুপটু একটু বাদে তার দিদির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ক্ষণা ব্যাগট্যাগ গোছাতে গোছাতে বলে, ওর আজও বোধহয় মিটিং। এল না। চলুন, আমরা চলে যাই।
আমি দাঁতে দাঁত টিপে রাখি। এবার আমাকে সত্যিই বেপরোয়া কিছু করতে হবে। সময় চলে যাচ্ছে।
হিংস্র আঙুলে শাটারটা টিপে টাইমার চালু করেই আমি দুই লাফে ক্ষণার পাশে এসে পড়ি। ক্ষণা অবাক হওয়ারও সুযোগ পায় না। আমি ক্ষণার গালে গাল ঠেকিয়ে বসেই ওর কাঁধে হাত রেখে বলি, ক্ষণা, দেখো!
ক্ষণা আমার দিকে অবাক মুখ ফিরিয়ে বলল, কী দেখব?
ওই যে, একটা অদ্ভুত পাখি উড়ে গেল।
ক্ষণা খুব বিস্মিত, বিরক্ত। আমি ক্ষণার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বললাম, বোধহয় চিড়িয়াখানার সেই ম্যাকাও পাখিটা পালিয়ে গেল।
ক্ষণা সরে বসে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, আপনার কী হয়েছে বলুন তো? এমন সব কাণ্ড করছেন।
অনেকক্ষণ আগে সেলফ টাইমার শেষ হয়েছে। আমার সারা শরীরে ঘাম দিচ্ছে। হাত পা কাঁপছে উত্তেজনায়। অবসাদে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
.
পরদিন প্রিন্টটা দেখল সুবিনয়। ছবিটা ব্লো-আপ করা হয়েছে বিরাট করে।
নট ব্যাড চাম। ইউ হ্যাভ মেড প্রোগ্রেস। – বলে হাসল।
ছবিটা অসম্ভব ভাল হয়েছে। পিছনে মস্ত একটা খেজুর গাছের মতো ঝুপসি গাছ, সেই পটভূমিতে আমাদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমার গালের সঙ্গে প্রায় ছুঁয়ে ক্ষণার গাল, ওর কাঁধে আমার হাত। দু’জনেই দুজনের দিকে হেলে বসে আছি। কী সাংঘাতিক স্ক্যান্ডালাস ছবি! অথচ কত মিথ্যে!
সুবিনয় হুইস্কির গেলাস হাতে নিয়ে ঘরের এক কোণ থেকে অন্য কোণ পর্যন্ত পায়চারি করছিল। মুখে মৃদু একটু হাসি, আর অন্যমনস্কতা। এক সময়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, হ্যাভ ইউ ফলেন ইন লাভ উইথ হার বাড়ি?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, জানি না।
ইউ লুক ডিফারেন্ট। কাঁধ ঝাঁকিয়ে সুবিনয় বলে।
আমি শ্বাস ছাড়লাম। হয়তো সত্যিই আমাকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। আমি কি একটু মোটা হয়েছি! আজকাল ঘুম হয়। খিদের চিন্তায় কষ্ট পাই না।
ঠিক আগের দিনের মতো সুবিনয় আজও একশো টাকার পাঁচখানা নোট ছুড়ে দিল আমার দিকে। বলল, এক্সপেন্সেস।
মাথা নাড়লাম। উত্তেজনায় শরীর গরম হয়ে ওঠে।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চেয়ে হাঃ করে সুবিনয় একটা শব্দ করল। তারপর বলল, আমি কাউকে বিশ্বাস করি না উপল। আই বিলিভ নান, অ্যান্ড দ্যাট মেকস মি ভেরি লোনলি।
কথাটা আমি বুঝতে পারলাম না। কিন্তু চিন্তা করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করলাম। তারপর উঠে চলে এলাম এক সময়ে। সুবিনয় এখন অনেক রাত পর্যন্ত মদ খাবে।
দু দিন পর সুবিনয় তার সুটকেস গুছিয়ে দিল্লি গেল। আসলে কোথাও গেল না। শুধু আমি জানলাম, সুবিনয় সাউথ এন্ড পার্কের ফ্ল্যাটে ক’দিন লুকিয়ে থাকবে। আমাকে গোপনে বলল, নাউ ইউ উইল বি ইন এ ফ্রি ওয়ার্ল্ড। বোথ অব ইউ।
দীর্ঘ খরার পর সেই রাতে অসম্ভব বৃষ্টি নামল। কী যে প্রবল বৃষ্টি। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে অবিরল ছাঁট আসতে লাগল। ঘুমের চটকা ভেঙে উঠে বসলাম। গহিন মেঘ সিংহের মতো ডাকছে। জলপ্রপাতের মতো নেমে আসে জল।
বিছানা গুটিয়ে প্যাকিং বাক্সগুলো যত দূর সম্ভব দেওয়ালের দিকে সরিয়ে আনতে থাকি। একটু-আধটু শব্দ হয়। বিছানাটা পেতেও কিন্তু শোয়া হয় না, বৃষ্টির ছাঁট হু হু করে সমস্ত বারান্দাকে ছেয়ে ফেলছে।
আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপ করে বসে থাকি বাতি নিবিয়ে। কিছু করার নেই। ঝড় বৃষ্টি আমাকে অনেক বার সহ্য করতে হয়েছে। আজও বসে বসে গাড়লের মতো ভিজতে থাকি।
সুবিনয় আর ক্ষণার ঘরের দরজা খোলবার শব্দ হল। আমার পাঁজরার নীচে ভিতু খরগোশের মতো একটা লাফ দিল হৃৎপিণ্ড। কোনও কারণ নেই। তবু।