হ্যাঁ শুনেছি, আপনি নাকি ভালই গাইতেন!
ছবি আঁকতাম।
ক্ষণা ভ্রু কুঁচকে বলল, এ সব তো আমি জানি। আপনি খুব ব্রিলিয়ান্ট ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনার কিছু হয়নি।
দুঃসাহস ভরে বললাম, আমার বুকের মধ্যে অনেক কথা জমা আছে বুঝলেন! তেমন মানুষ পাই না যাকে শোনাব।
তেমন মানুষ ক্ষণাও নয়। সে শুনতে চাইল না। শুধু বলল, শুনিয়ে কী হবে? সকলের বুকেই কিছু না কিছু কথা জমা থাকে। আমারও কি নেই?
আশান্বিত হয়ে বলি, আছে?
থাকতেই পারে।
বলবেন আমাকে?
ক্ষণা একটু অবাক হয়ে বলল, আপনার আজ কী হয়েছে বলুন তো!
রাস্তার একটা বিধবা বুড়িকে বাঁচাতে গিয়ে ট্যাক্সিটা জোর একটা টাল খেল। আমার মাথাটা বেটাল হয়ে দরজায় ঠুকে গেল একটু। যত না লেগেছে তার চেয়ে কিছু বেশি মাত্রা যোগ করে বললাম, উঃ!
ব্যথা পেলেন?
ভীষণ।
দেখি! বলে ক্ষণা একটু ব্যর্থ হয়ে মুখ এগিয়ে আনে।
আমি মাথাটা এগিয়ে আঙুলে ব্যথার জায়গাটা দেখিয়ে বলি, এইখানে।
ক্ষণার মনে কোনও দুর্বলতা নেই। সে দিব্যি ব্যথার জায়গাটা আঙুল বুলিয়ে পরীক্ষা করছিল। কিন্তু সেই স্পর্শে আমার ভিতরে বিদ্যুৎ খেলছে। সেটা প্রেমের অনুভূতি নয়। ভয়ের।
ক্ষণা নিজের জায়গায় সরে গিয়ে বলল, তেমন কিছু হয়নি। মন্দিরে গিয়ে একটু ঠান্ডা জল দেবেন ঠিক হয়ে যাবে।
এই ব্যথার প্রসঙ্গ থেকে অনায়াসেই আমি হৃদয়ের কথায় সরে গিয়ে বলতে পারতাম, ব্যথা কি শুধু ওইখানেই ক্ষণা? হৃদয়েও। কিন্তু প্রথমেই অতটা বাড়াবাড়ি কতে সাহস হল না।
দক্ষিণেশ্বরে ক্ষণা জুতো জমা রেখে পুজো দিতে গেল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, পরস্ত্রী নিয়ে আমার এই কর্মতৎপরতা কবে নাগাদ শেষ হবে।
বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে পুজো দিল ক্ষণা। যখন বেরিয়ে এল তখন বেশ বেলা হয়েছে। বেরিয়ে এসেই বলল, উপলবাবু, ট্যাক্সি ডাকুন।
আমি উদাস স্বরে বললাম, গঙ্গার ধার ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন?
এখন গঙ্গা দেখবার সময় নেই। দোলন আর ঘুপটুর জন্য মন কেমন করছে। ওরাও মা ছাড়া বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।
অন্তত পঞ্চবটীটা ঘুরে যান। হনুমানকে খাওয়াবেন না?
নিতান্ত অনিচ্ছায় ক্ষণা রাজি হল। রবিবারের ভিড়ে পঞ্চবটী এলাকা থিকথিক করছে। হাজারটা বাচ্চার চেঁচানি, লোকজনের চিৎকার। এর মধ্যে কোনও সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা বৃথা। তবু সহজ হওয়ার জন্য আমি ক্ষণার পাশাপাশি হেঁটে ঘুরতে লাগলাম। কী বলি? কী বললে ক্ষণার হৃদয়কম্পাসের কাঁটা কেঁপে উঠবে তা আকাশ-পাতাল ভেবেও ঠিক করতে পারছিলাম না।
হঠাৎ বললাম, একটা জিনিস দেখবেন?
কী?
আমি অবিকল হনুমানের নকল করতে পারি।
যাঃ!
সত্যি।
বলে আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। ক্ষণার হাতখানা হঠাৎ ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলাম গঙ্গার আঘাটায় একটু ফাঁকা মতো জায়গায়। আমার আচরণে ক্ষণা অবাক হয়েছে ভীষণ।
একটু হেসে বললাম, আমার সব আচরণকে মানুষের যুক্তি দিয়ে বিচার করবেন না। আমার মধ্যে হনুমানের ইনস্টিংক্ট আছে।
ক্ষণা হাসল না। তবে রাগও করল না। কেবল বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ল।
আমি ওর পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে প্রথমে চমৎকার কুক কুক ধ্বনি দিয়ে হনুমানের ডাক নকল করে শোনালাম। তারপর দেখাতে লাগলাম হনুমানের পেট চুলকোনো, চোখের পিটির পিটির, উকুন বাছা, বানর নাচ, মুখ ভ্যাঙাননা।
দু-চারজন করে আমার চারধারে লোক জমে যেতে লাগল। বাচ্চারা হাতে তালি বাজাচ্ছে, লোকজন চেঁচিয়ে বলছে, ঘুরে-ফিরে দাদা। একদম ন্যাচারাল হচ্ছে।
অনেক দিন বাদে পাবলিকের সিমপ্যাথি পেয়ে আমার বেশ ভাল লাগছিল। শেষে গাছ থেকে হনুমানগুলো পর্যন্ত হুপ হুপ করে সাবাস জানাতে থাকে। একটা ছোকরা বলল, দাদা, ওরা আপনার আসল চেহারা চিনতে পেরে গেছে। ডাকছে।
ঘেমে-নেয়ে যখন খেলা শেষ করেছি তখন ভিড়ের মধ্যে ক্ষণা নেই। ভিড় ঠেলে চার দিকে খুঁজতে লাগলাম ওকে। নেই। মাথাটা কেমন ঘোলাটে লাগছিল। খুব কি বোকামি হয়ে গেল। কিন্তু একটা কিছু বাঁধভাঙা কাজ তো আমাকে করতেই হবে। নইলে ও আমাকে আলাদা করে লক্ষ করবে কেন?
হতাশ এবং শ্লথ পায়ে নতমুখে আমি বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকি। মনের মধ্যে নানা রকম টানা-পোড়েন।
বাসরাস্তার দিকে আনমনে হেঁটে যাচ্ছিলাম, একটা থেমে থাকা ট্যাক্সির দরজা একটু খুলে ডাকল, উপলবাবু।
কেঁপে উঠি। কোনও কথা বলতে পারি না। তাকাতেও পারি না ক্ষণার দিকে। শুধু, বাধ্য চাকরের মতো সিটে ওর পাশে উঠে বসি।
কথাহীন নৈঃশব্দ্যে গাড়ির ভিতরটা ভারাক্রান্ত। শুধু মোটরের একটানা আওয়াজ।
শ্যামবাজার পার হয়ে গাড়ি সার্কুলার রোডে পড়ল। ক্ষণা বাইরের দিকে ফেরানো মুখখানা ধীরে আমার দিকে ঘুরিয়ে এনে বলল, আপনার অডিয়েন্স খুশি হল?
আমি লজ্জায় মরে গিয়ে মাথা নেড়ে বললাম, আমার অডিয়েন্স কেউ তো ছিল না।
ওমা! সে কী! অনেক লোককে তো জুটিয়ে ফেললেন দেখলাম!
ম্লান হেসে বললাম, আমার একজন মাত্র অডিয়েন্স ছিল। সে তো দেখল না!
সে কে?
আপনি।— বলে আমি চতুর হাতে টেপ-রেকর্ডার চালিয়ে দিই।
আমি! আমি কেন আপনার অডিয়েন্স হতে যাব? ও রকম ভাঁড়ামো করছিলেন কেন বলুন তো? ভারী বিশ্রী।
আমি মৃদুস্বরে বললাম, আপনি সেই বাজিকরের গল্পটা কি জানেন! যে কেবল নানা রকম খেলা দেখিয়ে বেড়াত রাস্তায় রাস্তায়! তার আর-কিছু জানা ছিল না। সে একদিন মাতা মেরির মন্দিরে গিয়ে দেবীকে ভক্তিভরে তার সেই বাজির খেলা নিবেদন করেছিল। দেবী সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। আমিও ওই বাজিকরের মতো আমার যা আছে তাই দিয়ে আপনাকে খুশি করতে চেয়েছিলাম।